শনিবার, ৯ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

বরিস জনসনের গদি হারানোর পাঁচ কারণ

প্রতিদিন ডেস্ক

বরিস জনসনের গদি হারানোর পাঁচ কারণ

তিন বছরও হয়নি ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ১৯৮৭ সালের পর কনজারভেটিভদের সবচেয়ে বড় বিজয় এনে দিয়েছিলেন বরিস জনসন। সেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকেই নিজের দলের পার্লামেন্ট সদস্যদের সমর্থন হারিয়ে বিদায় নিতে হলো। এ ছাড়া বরিস জনসনের উত্তরসূরি কে হচ্ছেন- এ আলোচনাও হচ্ছে জোরেশোরে। গদি হারানোর বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।

ক্রিস পিনচার কেলেঙ্কারি : গত ২৯ জুন পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ পার্টির তৎকালীন ডেপুটি চিফ হুইপ ক্রিস পিনচার লন্ডনে একটি ‘সংরক্ষিত’ ক্লাবে যান এবং তার ভাষায়, সেদিন তিনি ‘অনেক বেশি পান করেছিলেন’ এবং সে কারণে ‘নিজেকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছিলেন’। কী করেছিলেন পিনচার? সেখানে দুজন পুরুষকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। এর জের ধরে তার বিরুদ্ধে কয়েক বছরের পুরনো অনেক যৌন অসদাচরণের অভিযোগ বেরিয়ে আসে।

পার্টি কেলেঙ্কারি : চলতি বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীকে জরিমানা গুনতে হয়েছে কড়া লকডাউনে জন্মদিনের উৎসব আয়োজন করার কারণে। তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যাকে পদে থাকা অবস্থায় আইনভঙ্গের জন্য জরিমানা দিতে হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি, জনগণের ওপর করের বোঝা : বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় অনেক দেশের মতো যুক্তরাজ্যেও চলতি বছর মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে বেড়েছে, অর্থনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ সূচক উঠেছে ৯ দশমিক ১ শতাংশে।

যুক্তরাজ্য সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় জ্বালানি তেলের ওপর থেকে শুল্ক কমানোসহ কিছু পদক্ষেপ নিলেও এপ্রিলে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

ওয়েন প্যাটারসন বিতর্ক : ২০২১ সালের অক্টোবরে হাউস অব কমনস কমিটি তৎকালীন কনজারভেটিভ এমপি ওয়েন প্যাটারসনকে ৩০ দিনের জন্য বহিষ্কারের সুপারিশ করে। কমিটি জানায়, ওয়েন প্যাটারসন লবি বা তদবির করতে গিয়ে বিধিভঙ্গ করেছেন। তিনি কিছু কোম্পানিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যারা তাকে অর্থ দিয়েছেন।

মনোযোগ আর উদ্ভাবনী চিন্তায় ঘাটতি : ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’ বা ‘ব্রেক্সিট কার্যকর করা হোক’- এই সরল নীতির ওপর ভর করে সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করেছিলেন বরিস জনসন।

অথচ তারপর থেকে ডাউনিং স্ট্রিটে মনোযোগে ঘাটতি ও নতুন ভাবনা-চিন্তার অভাব দেখা দেয় বলে জনসনের সমালোচকদের ভাষ্য।

কে হচ্ছেন জনসনের উত্তরসূরি : জনসনের স্থলাভিষিক্ত কে হচ্ছেন এখন তা নিয়ে চলছে আলোচনা।

লিজ ট্রাস : যুক্তরাজ্যের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। দলের তৃণমূল পর্যায়ে যিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। কনজারভেটিভ হোম ওয়েবসাইটে দলের সদস্যদের মধ্যে হওয়া জনমত জরিপে ট্রাস নিয়মিত সবার ওপরে থাকেন বলে জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

জেরেমি হান্ট : সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট ২০১৯ সালে দলীয় প্রধান হওয়ার নির্বাচনে জনসনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। বিতর্কিত জনসনের এভাবে চলে যাওয়ার পর তিনি দলকে আরও রাশভারী এবং কম বিতর্কিত স্টাইলের নেতৃত্বের প্রস্তাব দিতেই পারেন। আর তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা যে ‘একেবারে শেষ হয়ে যায়নি’ সে কথা তিনি এ বছরের শুরুতে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।

বেন ওয়ালেস : প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস সম্প্রতি দলের ভিতর জনপ্রিয়তায় কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা লিজ ট্রাসকেও টেক্কা দিচ্ছেন।

ঋষি সুনাক : ভারতীয় বংশো™ভূত ৪২ বছর বয়সী এ নেতা একসময় বরিস জনসনের উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। কভিড-১৯ মহামারির সময় শিল্প প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কর্মীদের জন্য হাজার কোটি পাউন্ডের প্রণোদনা দেওয়ায় ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল সদ্য পদত্যাগী ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রীর নাম। তবে চলতি বছরের শুরুর দিকে তার ধনী স্ত্রীর অ-আবাসিক ট্যাক্স স্ট্যাটাস এবং জনসনের সঙ্গে লকডাউনের সময় নিয়ম ভাঙায় তারও জরিমানা হওয়া তার ইমেজকে খানিকটা নষ্ট করেছে।

সাজিদ জাভিদ : কনজারভেটিভ পার্টির একজন এমপির বিরুদ্ধে ওঠা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জনসন জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করেছেন এমন কথা বলে এর প্রতিবাদে তার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করা প্রথম মন্ত্রী সাজিদ জাভিদ। তিনি জনসনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। যুক্তরাজ্য সরকারের আরও ছয়টি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। সাবেক ব্যাংকার সাজিদ সব সময় মুক্তবাণিজ্যের পক্ষে কথা বলেছেন। ২০২০ সালে তিনি জনসনের অর্থবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পদত্যাগ করেন। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাজিদ ২০১৯?সালে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচনের দৌড়ে চতুর্থ হয়েছিলেন।

নাদিম জাওয়াই : সদ্য যুক্তরাজ্যের চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পাওয়া নাদিম জাওয়াই ভ্যাকসিন মন্ত্রী হিসেবে যুক্তরাজ্যজুড়ে বেশ প্রশংসা পেয়েছেন। তার নেতৃত্বেই বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাজ্যে সব থেকে দ্রুতগতিতে কভিড টিকা দেওয়া হয়। গত মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী ঋসি সুনাক পদত্যাগ করার পর অর্থমন্ত্রীর পদ নাদিমকেই দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। নাদিম এর আগে শিক্ষা সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ইরাকের এক কুর্দি পরিবারে জন্ম নেওয়া নাদিম দেশটির সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের আমলে দেশ ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্যে আসেন। তখন ঠিকমতো ইংরেজি বলতে না পারা শিশুটিই কঠোর পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তার জোরে আজ যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এক নাম। তেল শিল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে ৫৫ বছর বয়সী এ নেতার।

পেনি মর্ডান্ট : কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে জনপ্রিয় এমপিদের একজন পেনি মর্ডান্ট। প্রধানমন্ত্রী হয়েই জনসন যাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করেছিলেন। বর্তমানে জুনিয়র বাণিজ্যমন্ত্রী মর্ডান্ট লকডাউনের মধ্যে জনসনের মদের পার্টির ঘটনাকে ‘লজ্জাজনক’ বলেছিলেন।

জনসনের এখনই বিদায় নেওয়া উচিত- জন মেজর : যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজর বলেছেন, নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী বাছাই না হওয়া পর্যন্ত বিদায়ী নেতা বরিস জনসনের ডাউনিং স্ট্রিটে থাকা উচিত নয়। বৃহস্পতিবার জনসন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও এ পদ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগের চাপের কাছে নতিস্বীকার করেননি। টোরি (কনজারভেটিভ) দল নতুন একজন উত্তরসূরি নির্বাচন না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার পরিকল্পনা জানিয়েছেন তিনি। এরই প্রতিক্রিয়ায় সরকারি একটি চিঠিতে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর বলেন, মন্ত্রিসভা, সরকার এবং পার্লামেন্টারি দলের সমর্থন ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার প্রস্তাব (এই সময়কাল হতে পারে তিন মাস পর্যন্ত) বিচক্ষণ নয়। এই শাসনব্যবস্থা টেকসই না হওয়ার আশঙ্কা আছে।

অস্ত্র সংগ্রহে ইউক্রেনকে যেভাবে সহায়তা করছিলেন জনসন : রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর পশ্চিমা নেতাদের মধ্যে যারা কিয়েভের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহস দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, বরিস জনসনের নাম তাদের মধ্যে ওপরের দিকে। ব্রিটিশ এই প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের কারণেই যুক্তরাজ্য ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর গুরুত্বপূর্ণ হাব হয়ে উঠেছে। লন্ডন একদিকে নিজেরা যেমন কিয়েভকে অস্ত্র দিয়েছে, তেমনি মিত্রদের মধ্যে কারা কী কী অস্ত্র দিতে পারে, ইউক্রেন কাদের কাছ থেকে সহজে অস্ত্র পেতে পারে সে কাজে সমন্বয়ও করে চলেছেন। জনসনের পদত্যাগে ব্রিটেনের এই ভূমিকা বদলে যাবে কি না, তা নিয়ে এরই মধ্যে কানাঘুষাও শুরু হয়ে গেছে। তবে বিদায়ী টোরি প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেনে যুক্তরাজ্যের সহায়তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে কিয়েভকে আশ্বস্ত করেছেন।

গদি ছাড়ার আগে বিয়ের জমকালো পার্টি : যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ক্ষমতা ছাড়ার আগে এ মাসের শেষের দিকে সরকারি বাসভবন চেকার্সে ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে তার বিয়ের জমকালো পার্টি দেওয়ার পরিকল্পনা বদলেছেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, এখনো কোনো কিছুই ১০০ ভাগ নিশ্চিত নয়। বিয়ের পার্টির জন্য অন্য কোনো বিকল্প স্থান বেছে নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর