শিরোনাম
বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা
প্রেসিডেন্ট ভবন জনতার দখলে, তীব্র রাজনৈতিক সংকট, কে দায়িত্ব নেবেন

বিক্ষোভে পালালেন লঙ্কান প্রেসিডেন্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিক্ষোভে পালালেন লঙ্কান প্রেসিডেন্ট

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট ভবনে বিক্ষুব্ধ জনতা, ভিতরে সুইমিং পুলে উল্লাস ও পালঙ্কেও নিয়েছে অবস্থান

৭৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে এখন শ্রীলঙ্কা। এক সময়ের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশটিতে চলছে চরম খাদ্য সংকট। জ্বালানি তেল কিনতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুও হয়েছে কয়েকজনের। ওষুধসহ নিত্যপণ্যের সংকটে জনজীবন বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল দ্বীপরাষ্ট্রটি। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন দখলে নিয়েছেন। বিপদ আঁচ করতে পেরে গত শনিবারই গোপন দরজা দিয়ে ভবন ছেড়ে পালিয়ে যান গোতাবায়া রাজাপক্ষে। গতকাল তিনি বিমানযোগে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এখন নৌপথে দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। তবে এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট কোথায় অবস্থান করছেন সেই খবর জানা যায়নি। এদিকে গোতাবায়া রাজাপক্ষে বর্তমানে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল সুদর্শনা পাথিরানার একটি ব্যক্তিগত বাড়িতে অবস্থান করছেন বলে গতকাল চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই খবর প্রত্যাখ্যান করেছে বিমানবাহিনী। এদিকে গতকাল দেশটির সুপ্রিম কোর্টে রাজাপক্ষের পরিবার ও অন্যান্য প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে একটি পিটিশন দাখিল হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, তেল আর গ্যাসের চরম সংকট দেখা দেওয়ায় বাধ্য হয়ে কাঠ পুড়িয়ে রান্না এবং গাড়ি ছেড়ে সাইকেলে যাতায়াত শুরু করেছেন শ্রীলঙ্কার অনেক মানুষ। জ্বালানির জন্য গাছ কেটে পরিবেশের ক্ষতি করার প্রবণতা বেড়েছে। অন্যদিকে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সাইকেলের দামও বাড়ছে হু হু করে। শ্রীলঙ্কা সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের বর্ণনায় উঠে এসেছে      লঙ্কানদের দুর্দশার করুণ চিত্র। তিনি বলেন, ‘হোটেলের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। কয়েকজন ড্রাইভারের সঙ্গেও কথা বলেছি। তাদের কী কষ্টই না হচ্ছে! একদিন খেলে পরের দিন খাচ্ছেন না যাতে সন্তানদের খাওয়াতে পারেন। কী কষ্ট!’

আজ পদত্যাগ প্রেসিডেন্টের : দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং তার পরিবারকে দায়ী করে আসছে শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভকারীরা। গত দুই দশক ধরে দ্বীপ রাষ্ট্রটির ক্ষমতায় রয়েছে রাজাপক্ষে পরিবার। প্রবল বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে  গত মে মাসে পদত্যাগে বাধ্য হলেও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ছিলেন অনড়। তবে শ্রীলঙ্কাভিত্তিক পত্রিকা ডেইলি মিররের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভের মুখে গত সোমবার তিনি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেছেন। যদিও যে পদত্যাগপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেছেন তার তারিখ দেওয়া আছে ১৩ জুলাই, বুধবার। আজ পার্লামেন্টের স্পিকার ইয়াপা আবিবর্ধনে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের বিষয়টি জনসমক্ষে জানাবেন বলে জানা গেছে।

২০ জুলাই নির্বাচন : গোতাবায়া রাজাপক্ষে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর রাজনৈতিক সংকট এড়াতে নতুন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের তারিখ ঠিক করেছে শ্রীলঙ্কা। স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে গত সোমবার জানিয়েছেন, ১৫ জুলাই থেকে ফের অধিবেশনে বসবে পার্লামেন্ট। আর ২০ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ১৯ জুলাই পার্লামেন্টে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন আগ্রহীরা। পরদিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট হবে। এদিকে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা ও আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেও পদত্যাগ করতে চান বলে জানিয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দফতর।

প্রেসিডেন্টের বাসভবনে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান : গত শনিবার বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট প্যালেস, প্রেসিডেন্সিয়াল সচিবালয় দখলে নেয়। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট ভবনে ঢুকে সুইমিং পুলে গোসল, ফটোসেশন, রান্নাঘরে ঢুকে খাবারের আয়োজনসহ রাতেও সেখানে অবস্থান করছেন। বিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্টের বাসভবন থেকে পালাতে বাধ্য হন ৭৩ বছর বয়সী গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। গতকাল শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন টেম্পল ট্রিতে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন।

দেশ ছাড়ার চেষ্টা : শ্রীলঙ্কার কোনো আইনেই ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে গ্রেফতারের বিধান নেই। তাই পদত্যাগের পর গ্রেফতার এড়াতে প্রেসিডেন্ট বিদেশ যেতে পারেন এমন ধারণায় বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থান নিয়েছে হাজারো বিক্ষোভকারী। এর মধ্যেই শনিবার বাসভবন ছেড়ে পালানোর পর গতকাল বিমানযোগে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এএফপি জানায়, পদত্যাগপত্রে সই করে দেশ ছাড়ার জন্য বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট। কিন্তু বিমানবন্দরের অভিবাসন কর্মকর্তাদের কেউ তার পাসপোর্টটি সিল করেননি। এদিকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা এএফপিকে জানান, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগীরা একটি টহলকারী নৌযানে তাদের বিদেশ যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছেন। জানা গেছে, গত শনিবার প্রবল বিক্ষোভের মুখে সরকারি বাসভবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর নৌবাহিনীর নৌকা ব্যবহার করে রাজাপক্ষে ও তার সহযোগীদের উত্তর-পূর্ব বন্দর শহর ত্রিনকোমালিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে গতকাল সোমবার তারা দুবাইয়ে যাওয়ার উদ্দেশে হেলিকপ্টারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন। বিমানবন্দরের পাশে একটি সামরিক ঘাঁটিতে সস্ত্রীক রাত কাটান তিনি। গতকাল বিমানযোগে পালাতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন তিনি নৌপথে মালদ্বীপ বা ভারতে গিয়ে দুবাইয়ের ফ্লাইট ধরার চেষ্টা করতে পারেন বলে প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক কর্মকর্তা এএফপিকে জানিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মাত্তালা থেকে একটি ফ্লাইট ভাড়া করেও যেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে গত এপ্রিলে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করা রাজাপক্ষের ছোট ভাই বাসিলকেও একইভাবে দেশ ছাড়তে দেননি বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা। শ্রীলঙ্কান ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে বাসিল রাজাপক্ষের।

গোপন বাংকার নিয়ে জল্পনা : গোতাবায়া রাজাপক্ষের সরকারি বাসভবন দখলে নেওয়ার পর সেখানে একটি গোপন বাংকার খুঁজে পেয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তবে তারা ওই বাংকারে নামতে পারলেও এর শেষ প্রান্তে থাকা মজবুত ধাতব দরজা খুলতে পারেননি। জনগণের ‘লুটের’ অর্থ গোটাবায়া ওই গোপন দরজার অন্যপাশে লুকিয়ে রেখেছেন বলে দাবি করেছেন বিক্ষোভকারীদের অনেকে।

দেউলিয়া ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর : বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় বাসভবনে ঢুকে পড়ার আগে দেশের অর্থনীতির চরম দুরবস্থার কথা সরকারি পর্যায় থেকে স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেন, মোট ঋণ ৫০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কা এখন ‘দেউলিয়া দেশ’।

সর্বশেষ খবর