শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

লঙ্কাকাণ্ডে কী হবে শ্রীলঙ্কার

অবশেষে পদত্যাগ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার, শৃঙ্খলা ফেরাতে সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

লঙ্কাকাণ্ডে কী হবে শ্রীলঙ্কার

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর রাস্তায় নিরাপত্তা বাহিনীর সশস্ত্র অবস্থান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সোফায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতেই বিক্ষোভকারীদের বিশ্রাম। কার্ড খেলতে দেখা যায় অনেককে। মিটিং রুমেও বিক্ষোভকারীদের অবস্থান ছবি : এএফপি ও বিবিসি

লঙ্কাকাণ্ড চলছে শ্রীলঙ্কায়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে দেশটি। শ্রীলঙ্কায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বলতে এখন কিছুই নেই। উল্টো মোট ঋণ ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ায় দেশটিকে ‘দেউলিয়া’ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। অর্থ সংকটে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ অধ্যুষিত শ্রীলঙ্কা খাবার, ওষুধ, জ্বালানির মতো অতি জরুরি পণ্যও আমদানি করতে পারছে না। ভয়াবহ গণআন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। অবশেষে করেছেন পদত্যাগ। নিজেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে। তাতে আপত্তি জানিয়েছে বিরোধী দলগুলো। দেশজুড়ে চলছে জ্বালাও-পোড়াও। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ঘটেছে হতাহতের ঘটনা। জারি করা হয়েছে কারফিউ। অনিশ্চিত গন্তব্যে চলেছে শ্রীলঙ্কা। এমন পরিস্থিতিতে একসময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশটিতে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। শ্রীলঙ্কার সাবেক ক্রিকেটার সনাৎ জয়সুরিয়ার মতে, দেশের এমন দুঃখজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে মূল দায়টা রাজনৈতিক নেতাদের। পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘খুবই দুঃখজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন। বিদ্যুৎ নেই, জ্বালানি নেই, এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধও নেই। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে!’ সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার কাছে চীনের পাওনা ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় শ্রীলঙ্কার সরকারি কর্মকর্তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অপরিশোধিত বিদেশি ঋণ দেশটির জিডিপির ৯৪ শতাংশই গ্রাস করে ফেলবে। সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে। গোতাবায়া পালানোর পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় শ্রীলঙ্কায় যা ঘটবে তা দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বেশ বড় ভূমিকা রাখবে বলে দাবি করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এদিকে জনরোষের মুখে ১৩ জুলাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগের কথা থাকলেও তা না করেই ১২ জুলাই দিবাগত গভীর রাতে সামরিক বাহিনীর বিমানে প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপে পালিয়ে যান তিনি। সেখানে গিয়েও বিমানবন্দরে সেখানকার বাসিন্দাদের রোষে পড়েন। পরে মালদ্বীপ থেকে স্থানীয় সময় গতকাল সন্ধ্যা ৭টা ১৭ মিনিটে স্ত্রী ও দুই দেহরক্ষীকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে পৌঁছান গোতাবায়া। সিঙ্গাপুর পৌঁছে         ই-মেইলে গোতাবায়া পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন বলে এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে, সিঙ্গাপুরে গোতাবায়া রাজাপক্ষে শুধু ট্রানজিটের জন্য থাকবেন। আগামীকাল তিনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে যাবেন। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরে গোতাবায়ার প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাঁর প্রবেশ ‘ব্যক্তিগত’ উল্লেখ করে আরও জানানো হয়েছে, গোতাবায়া রাজনৈতিক আশ্রয় (অ্যাসাইলাম) চাননি। তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুরও করা হয়নি।

পদত্যাগপত্র না দিয়ে প্রেসিডেন্টের পলায়নে দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট নতুন মোড় নেয়। গোতাবায়ার দেশ ছেড়ে পালানোর পর বুধবার সকালেই নিজেকে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। এতে আরেক দফা শুরু হয় লঙ্কাকাণ্ড। তাঁর পদত্যাগের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হামলা করেন বিক্ষোভকারীরা। রাজধানীজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও ও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে বুধবার একজন নিহত ও অন্তত ৮৪ জন আহত হন। নিরাপত্তা বাহিনীর টিয়ার শেল নিক্ষেপের পর এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হামলার পর টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বলেন, দেশের শৃঙ্খলা ফেরাতে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর পরই বিশেষ এক সরকারি গেজেটে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে আজ (১৫ জুলাই) বিকাল ৫টা পর্যন্ত রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় কারফিউ জারি করেছে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বাধীন সরকার।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘোষণা করেছেন শ্রীলঙ্কার স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে। আর রাজাপক্ষের পলায়নের পর নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত ওই পদে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন রনিল বিক্রমাসিংহে। তবে বুধবার শ্রীলঙ্কায় সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়েছে। লঙ্কান নেতারা স্পিকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। জেলেনস্কির বরাত দিয়ে ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআই বলেছে, ইউক্রেনে আক্রমণে রাশিয়া যে প্রধান কৌশলগুলো ব্যবহার করেছে, এর মধ্যে একটি হলো দেশটিতে ‘অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা’ সৃষ্টি করা। তাঁর অভিযোগ, (ইউক্রেন থেকে) সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ব্যাঘাতের কারণে বেশ কয়েকটি দেশ খাদ্য ও জ্বালানির ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে। শ্রীলঙ্কা এর বাইরে নয়।

শ্রীলঙ্কার এ দুরবস্থার জন্য দেশটির অধিকাংশ মানুষ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং তাঁর বড় ভাই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের নেতৃত্বাধীন সরকারকে দায়ী করে তাঁদের পদত্যাগের দাবিতে মার্চ থেকেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। প্রায় চার মাস মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে চললেও কয়েক দিন ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে আন্দোলন পরিস্থিতি।

৯ জুলাই পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়েন একদল বিক্ষোভকারী। বাসভবন ছেড়ে পালিয়ে রাজধানীর কাছে একটি সামরিক ঘাঁটিতে আশ্রয় নেন গোতাবায়া।

এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপক্ষে দেশত্যাগ না করার বিষয়ে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে মুচলেকা দিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর