বুধবার, ২০ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

জাতিসংঘ-আইএমএফের সতর্কতা, উৎপাদন ও মজুদ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ

মানিক মুনতাসির

বিশ্বজুড়ে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। এর সঙ্গে একমত হয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও বলেছে, বৈশ্বিকভাবে যে হারে আমদানি পণ্য ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে তাতে মূল্যস্ফীতির ঘোড়াকে সামলে রাখা কঠিন হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশে উঠেছে। এ ছাড়া চীন, ভারত, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, কানাডাসহ বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনে নেতৃত্বাদানতারী দেশগুলোতে অতিরিক্ত বন্যা, খরা কিংবা দাবানলে বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ফলে উৎপাদন কমেছে। আগামী মৌসুমেও উৎপাদন কম হবে ব্যাপক হারে। এ জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব বিশ্ব নেতাদের সতর্ক করেছেন খাদ্য নিরাপত্তা ইস্যুতে। এ অবস্থায় নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে মজুদ বাড়াচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশও খাদ্য উৎপাদন এবং মজুদ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য কৃষি খাতের ভর্তুকি কমানোর আইএমএফের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকা সফররত আইএমএফের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করছে। এ সময় অর্থবিভাগের সঙ্গে বৈঠকে ভর্তুকি কমিয়ে আনার প্রস্তাব করে সংস্থাটি। অবশ্য অর্থবিভাগ তা নাকচ করে দিয়েছে বলে জানায় বৈঠকের একটি সূত্র।

এদিকে গত জুনের প্রথমদিকে জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে এ বছর খাদ্যশস্যের ফলন কম। এতে খাদ্যের বাজার নিয়ে গভীর শঙ্কা রয়েছে। প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে খাদ্যপণ্যের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ভারতসহ বেশির ভাগ গম রপ্তানিকারক দেশে এ বছর ফলন কমবে। একমাত্র রাশিয়ায় বাম্পার ফলন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে ঘাটতি পূরণে তা তেমন কাজে আসবে না। এমনকি ইউক্রেনেও বিপুল পরিমাণ গম উৎপাদন হয়ে থাকে যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে ইউক্রেন। এ বছর তা ব্যাপক হারে কমে আসবে। জাতিসংঘের আরেক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এ বছর চীনে সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। এতে দেশটির অন্তত ১০টি অঞ্চল ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছে। ফলে দেশটির প্রায় ৪ লাখ হেক্টর কৃষি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে অন্য বছরের তুলনায় দেশটিতে অন্তত ২০ শতাংশ উৎপাদন কম হবে। অস্ট্রেলিয়ায়ও গত ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র খরা হয়েছে। ফলে সেখানেও ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের কৃষি ক্ষতি হয়েছে। যা সেখানে উৎপাদনের ওপর তো বটেই বিশ্ববাজারে ব্যাপক হারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া ইতালি, ভারতেও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শুধু কানাডাতেও এতটাই ক্ষতি হয়েছে যে, দেশটিতে অন্তত ২৮ শতাংশ কম গম উৎপাদিত হবে আগের বছরের তুলনায়। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতি অন্তত নাজুক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, আগামী কয়েক মাসে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ফলে উচ্চমূল্যের কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির চরম অবনতি হবে। এ সংঘাত কমপক্ষে ১ কোটি মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, যা তৈরি করতে পারে দুর্ভিক্ষ।

বিশ্বে মোট গমের ৩০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ইউক্রেন ও রাশিয়ায়। আর ভুট্টার ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় এ দুই দেশে। যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে এ দুই দেশ থেকে গম ও ভুট্টাসহ অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বন্ধ হয়ে গোটা বিশ্বকে খাদ্যসংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, আগামী কয়েক মাসে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ফলে উচ্চমূল্যের কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির চরম অবনতি হবে। এ সংঘাত কমপক্ষে ১ কোটি মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, যা তৈরি করতে পারে দুর্ভিক্ষ। সহসাই যুদ্ধ বন্ধ না হলে সে দুর্ভিক্ষ চলতে পারে কয়েক বছর। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক যে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে, নতুন অর্থবছরের বাজেটে সাতটি বড় পদক্ষেপের মাধ্যমে সে ঝুঁকি মোকাবিলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি বছরব্যাপী দীর্ঘ না হয় তাহলে এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হবে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যপণ্যের দাম কমাতেও ভূমিকা রাখবে। ফলে দেশে মানুষের খাদ্য পাওয়ার নিশ্চয়তাও নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ খাদ্য মজুদ বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে ১৭ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদ দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ২৯ লাখ টন। এর মধ্যে চাল ১৩ দশমিক ৮৮ লাখ টন এবং গম ১ দশমিক ৬৬ লাখ টন। এ ছাড়া ধান ১ দশমিক ১৫ লাখ টন। আগামী মৌসুমেই এ মজুদ ২০ লাখ টনে উন্নীত করা হবে বলে জানিয়েছে খাদ্যবিভাগ। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন ধান এবং দানাজাতীয় ফসল মিলে সাড়ে ৪ কোটি টন খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। খাদ্য বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ বলেন, আমাদের বেশির ভাগ খাদ্যই সঞ্চিত থাকে জনসাধারণের ঘরে। ফলে আমরা খুব একটা চিন্তিত নই। কেননা আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খুবই ভালো। সামনের মৌসুমেও বাম্পার ফলন হবে। তবে আমদানিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে। এটার জন্য সরকার আগে থেকেই নানা রকম ব্যবস্থা নিয়েছে।

সর্বশেষ খবর