রবিবার, ২৪ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করলেও বাধা দেব না : প্রধানমন্ত্রী

গণতান্ত্রিকভাবে এলে চা খাওয়াব কথা শুনব

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করলেও বাধা দেব না : প্রধানমন্ত্রী

গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করলেও পুলিশ বাধা দেবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেন, তারা যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে আসে, তাদের পুলিশ যেন বাধা না দেয়। আসুক, আমি চা খাওয়াব-বসাব, কথা বলতে চাইলে শুনব। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।

গতকাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর যৌথসভায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী  গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি সভায় যুক্ত হন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি তো বলে দিয়েছি, বিশেষ করে বাংলামোটরে যে বাধা দেওয়া, সেটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি। আসুক না হেঁটে হেঁটে যতদূর আসতে পারে। কোনো আপত্তি নেই। তবে যদি বোমাবাজি ও ভাঙচুর করে তাহলে বাধা দেব এবং উপযুক্ত জবাব পাবে। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো বাধা নেই। তা তো করেই যাচ্ছে।  আওয়ামী লীগ সবসময় মানবতার সেবা করে আসছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, কিছু লোক আছে সারাক্ষণ দোষ ধরা, আর খুঁত ধরার চেষ্টায় থাকে। আমরা বিদ্যুতের লোডশেডিং দিচ্ছি, কারণ ডিজেলের দাম যেভাবে বেড়েছে, এলএনজির দামসহ প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বেড়েছে। যে জার্মানি সুর তুলেছিল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে না, তারা কিন্তু আবার সেটাতেই ফেরত গেছে। খাদ্য সরবরাহ পুনরায় চালু করতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চুক্তি করায় জাতিসংঘের মহাসচিব ও তুর্কি প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের উদ্যোগের ফলে, বিশেষ করে জাতিসংঘের মহাসচিবের উদ্যোগের ফলে এখন ইউক্রেন এবং রাশিয়া একটি চুক্তি করেছে। সার, খাদ্যদ্রব্য এগুলো যেতে দেবে। কৃষ্ণসাগরে যে বন্দর বন্ধ রয়েছে, সেটাতে চলাচলের সুযোগ করে দেবে। খাদ্যদ্রব্য এখন আনা যাবে, কেনা যাবে। আমি মনে করি, এটা আমাদের স্বস্তিকর বিষয়। এর মাধ্যমে খাদ্যের অভাব থাকবে না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বৃক্ষরোপণ, খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মৎস্য চাষে উদ্যোগী হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে কোথাও যেন এক ইঞ্চি জমি পড়ে না থাকে। যে যা পারেন উৎপাদন করেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সবসময় মানবতার সেবায় এগিয়ে আসে। আমরা ক্ষমতায় থাকলে জনগণের সেবা করি। আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকা মানে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অর্থ পাচার, মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকা। কারণ তারা মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসে। নির্বাচন নিয়ে সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে যদি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো শৃঙ্খলা এসে থাকে, তা আওয়ামী লীগের হাত ধরেই এসেছে। আমরা মহাজোট করেছিলাম, আমরা দলের পক্ষ থেকে মহাজোটের পক্ষ থেকে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। শুধু তাই না, ছবিসহ ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, যাতে সিল মেরে বাক্স ভরতে না পারে, তার দাবি করেছিলাম। শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সবসময় এ দেশের জনগণের ভোটের অধিকারে বিশ্বাসী। আমরা সেটাই বিশ্বাস করি। সেজন্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে যতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা আওয়ামী লীগের আমলেই হয়েছে।

দেশের জনসংখ্যা খুব একটা বাড়েনি : আদমশুমারিতে দেশের জনসংখ্যা খুব একটা বাড়েনি বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ১৬ কোটি ৫০ লাখ প্লাস। সামান্য কিছু হয়তো পরবর্তীতে বাড়বে বন্যাকবলিত এলাকা ধরে। কেউ আমাদের ১৮ কোটি বলে, ১৭ কোটি বলে, আমাদের কিন্তু এত জনসংখ্যা না। কাজেই এই মানুষগুলোকে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারব। সবই পারব। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ যতক্ষণ ক্ষমতায় আছে সবই পারব। কিন্তু লুটেরা এলে কী করবে তা জানি না। এতিমের অর্থ আত্মসাৎকারী, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারী, ১০ ট্রাক অস্ত্রের চোরাকারবারি, অর্থ পাচারকারীরা বিএনপির নেতা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে একটা মানুষও পায়নি তারা নেতা বানাতে। দলটির গঠনতন্ত্রের ৭ অনুচ্ছেদে আছে, সাজাপ্রাপ্ত আসামি হলে দলটির নেতা হতে পারবে না। কিন্তু বিএনপি তাই করেছে। শেখ হাসিনা বলেন, কথা যত পারুক বলুক। যদিও সারা দিন কথা বলার পর বলে আমাদের কথা বলতে দেয় না। মিটিং করে লোক হয় না, বলে আমাদের লোক আসতে দেয় না। অভিযোগ তো তারা করে। কিন্তু তাদের কাছে লোক আসবে কেন? কোন আশায় আসবে। সেটা হলো বাস্তব কথা, সেটা তো চিন্তা করতে হবে।

৩০০ আসনে সাড়ে ৭০০ মনোনয়ন দিলে জিতবে কী করে : ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে যারা কথা বলে, তারা কি এটা চিন্তা করেছে- ৩০০ আসনে যদি একটা দল সাড়ে ৭০০ মনোনয়ন দেয় তাহলে তাদের নির্বাচন হয় কী করে। একজন বিএনপি অফিস থেকে, আরেকজন লন্ডন থেকে, আরেকজন গুলশান অফিস থেকে (মনোনয়ন) দিচ্ছে। যারা এভাবে নির্বাচন করে তারা নির্বাচনে জিতবে কী করে? তাদের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক বিদ্যুতে বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়। যোগাযোগের অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়। বিএনপি সরকারের চিত্র তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, বিএনপির সময়ে বিদ্যুৎ, সার, শ্রমিকের ন্যায্য বেতন চাইতে গেলে গুলি করে মেরেছে। এই ঢাকা শহরেও তাদের এমপি বিদ্যুৎ ও পানি দিতে না পেরে দৌড় দিল। এসব যাদের আমলে ঘটেছে তাদের কাছ থেকে কথা শুনতে হয়।

জাতীয় শোকের মাসের কর্মসূচি : অনুষ্ঠানে জাতীয় শোকের মাস আগস্টের কর্মসূচি ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে : গতকাল ‘বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক-২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কভিড-১৯ মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি এবং সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছি। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং আমাদের সেগুলো অতিক্রম করতে হবে। গতকাল পাবলিক সার্ভিস দিবস উদযাপন এবং ‘বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক-২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী যুক্ত হন। অনুষ্ঠানে ২৭ জন কর্মকর্তা, তিনটি মন্ত্রণালয় ও একটি ইউনিটের কাছে পদক তুলে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক পদকপ্রাপ্তদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনা মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের (নিষেধাজ্ঞা) প্রভাবে সারা বিশ্বে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে। এ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, এ জন্য হয়তো আমাদের পত্র-পত্রিকা নানা কথা লিখবে ‘টকশো’তে নানা কথা বলবে, বিরোধী দল নানা কথা বলবে। হ্যাঁ বিরোধী দল বলবেই। কারণ বলাটাই তাদের কর্তব্য এবং তারা বলে যাক। কিন্তু আমাদের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমরা সঠিক পথে আছি কি না, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছি কি না, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি কি না এবং দেশের তৃণমূলের সাধারণ মানুষ যথাযথ সেবাটা পাচ্ছে কি না- আমরা যদি সেভাবে চিন্তা করি, তাহলে কে কী করল সেদিকে আমাদের খুব একটা নজর দিতে হবে না। সমালোচনা শুনে কোথাও কোনো ঘাটতি থাকার বিষয়টি পরীক্ষা করে নেওয়া যেতে পারে অভিমত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, কিন্তু এই কথা শুনে কেউ যেন বিভ্রান্ত বা হতাশাগ্রস্ত না হন, সেদিকে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে দেশের মাটি এত উর্বর, যেখানে বীজ ফেললেই গাছ ও ফল হয়, সে দেশে মানুষ খাদ্যের জন্য কষ্ট পেতে পারে না। কাজেই আমাদের যেটুকু সম্পদ তা যদি আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি, আমাদের মানবসম্পদ এবং মাটি সেটাকে কাজে লাগিয়েই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব বলে বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস যেতে না যেতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, ডলারে আদান-প্রদান বন্ধ করে দেওয়া, যে কারণে আজকে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশও ভুক্তভোগী। আজকে সার কেনা, খাদ্য কেনা বা জ¦ালনি তেল কেনার মতো বিষয়ে আমরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। সমগ্র বিশ্বই একটা দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দিয়ে একটি দেশকে শিক্ষা দেওয়ার ফর্মুলায় আজকে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো অনেক উন্নত দেশও বিপাকে পড়ে গেছে। আমাদের দেশে যেমন মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু অনেক উন্নত দেশে অনেক অনেক বেশি মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। জ¦ালানি তেলের দাম বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতায় বাংলাদেশ এখনো অনেক দেশ থেকে ভালো অবস্থায় থাকলেও আমাদের আপৎকালীন চিন্তায় আরও সাশ্রয়ী ও মিতব্যয়ী হতে হবে এবং যে কোনো প্রকার অপচয়কে রোধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে ভবিষ্যতে যেন আরও বেশি করে পদক দেওয়া সম্ভব হয়, সেজন্য সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।

এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে দেওয়া জাতির পিতার ভাষণেরও উল্লেখযোগ্য অংশ উদ্ধৃত করেন প্রধানমন্ত্রী। জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা আপনাদের জনগণের সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদেরকে জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থাৎ জনস্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ হয়েই আপনাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে, যেটা আপনারা করছেন আর আমাদের সংবিধানেও বলে দেওয়া হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এইচ এন আশিকুর রহমান এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম। এর আগে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।

সর্বশেষ খবর