সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

নামিদামি হাসপাতাল কিডনি বিক্রি চক্রে

সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় আরও চক্র

সাখাওয়াত কাওসার

নামিদামি হাসপাতাল কিডনি বিক্রি চক্রে

আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচা চক্র। মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯-এর ৯ ধারায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চক্রগুলো নানা কৌশলেই সক্রিয়। গরিব ও অভাবী মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে চক্রের সদস্যরা তাদের কিডনি বিক্রি করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। গত কয়েক মাসে কিডনি বিক্রির বিভিন্ন চক্রের ২৩ জন সদস্যকে গ্রেফতারের পর তদন্তে ঢাকা ও চট্টগ্রামের নামিদামি কিছু হাসপাতালের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে পুরোপুরি তদন্ত শেষ না হওয়ায় এখনই হাসপাতালগুলোর নাম প্রকাশ করতে চাইছেন না তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার ওপরও তাদের নজরদারি চলছে।

কিডনি কেনাবেচার বিষয়ে জয়পুরহাট জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি। এরই মধ্যে কিছু চক্রের সঙ্গে দেশের নামিদামি হাসপাতাল জড়িত থাকারও তথ্য পেয়েছি। তবে আমাদের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৫৩ জনকে আমরা গ্রেফতার করেছি। তবে কিডনি পাচারে সংশ্লিষ্টতার জন্য ১২০ জনকে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে।’

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হতদরিদ্রদের টার্গেট করে তাদের ঋণ দেয় চক্রের সদস্যরা। দিন দিন সুদের টাকা জমে পাহাড়ের আকার ধারণ করলে একপর্যায়ে তাদের কিডনি বিক্রি করার পরামর্শ দেয় তারা। কিডনি-দুর্বৃত্তরা সাধারণত গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট ও ফরিদপুর এলাকায় তাদের জাল বিস্তার করেছে। আবার অভাব দূর করতে কেউ ৩ লাখ কেউ ৪ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করছেন। কিডনি বিক্রি চক্রের অন্যতম হোতাদের মধ্যে রয়েছেন খুলনার একজন, কুমিল্লার দুজন এবং জয়পুরহাটের তিনজন- কাওসার, নাজমুল ও সাত্তার। এদের মধ্যে সাত্তার ২০১১ সাল থেকে কিডনি কারবারি চক্রের সঙ্গে জড়িত। তিনি এখন একটি চক্রের প্রধান। কিডনি চক্রের খপ্পরে পড়ে জয়পুরহাটের বিনইল গ্রামের মো. শাহাদুল ও এলতা গ্রামের শামীম ভারতে রয়েছেন। তাদের প্রথমে চট্টগ্রাম নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানেই তাদের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হবে বলে জানতে পেরেছেন আমাদের জয়পুরহাট প্রতিনিধি। এভাবে গত এক বছরে ওই জেলার কালাই উপজেলার বহুতি গ্রামের সাজেদা ও বেলাল, দুর্গাপুর গ্রামের গাজী ও সুলতানা, বিনাইল গ্রামের ভুট্টো, হাটপুকুর গ্রামের জাহেদুলসহ অন্তত ৩০ জন চক্রের ফাঁদে পড়ে কিডনি বিক্রি করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তাদের স্বজনরা। তাদেরই একজন বহুতি গুচ্ছগ্রামের ফিরোজ মিয়া। পেশায় ট্রাকের হেলপার। দালালের খপ্পরে পড়ে গত বছর মার্চ মাসে ৩ লাখ টাকায় ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করেন। এর বাইরেও কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের জয়পুর বহুতি গ্রামের মিলন হোসেন, মামুনুর রশিদ ও সালিদা ওরফে সাজেদা বেগম, দুর্গাপুর গ্রামের মান্না ও তার স্ত্রী, গাজীউল ইসলাম, সুলতানা বেগম, জাকারিয়া ও তার স্ত্রী শাপলা বেগম, বিনাইল গ্রামের ভুট্টো হোসেন ও সাহাদুল ইসলাম, এলতা গ্রামের শামীম ও রুবেল, থল গ্রামের সায়েম হোসেন, হাটপুকুরের জাহেদুল ইসলাম এবং উলিপুর গ্রামের আলমগীর হোসেনের নাম জানা গেছে, যারা নিজেদের কিডনি বিক্রি করেছেন।

অতি সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে একটি চক্রের পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। র‌্যাব-১ অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন জানান, চক্রের মূল হোতা শহিদুল ইসলাম মিঠু। ভারতে কিডনি রোগের চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিজেই অবৈধ কিডনি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে দেশেই নিজের তত্ত্বাবধানে গঠন করেন ২০ সদস্যের একটি স্কোয়াড। বিদেশে অবস্থানরতরা ১ নম্বর স্তরের সদস্য। তার নেতৃত্বাধীন দেশের দুটি স্তর। তাদের কাজ হলো দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা কৌশলে কিডনি বিক্রেতা সংগ্রহ করা। এই চক্র গত ছয় বছরে শতাধিক সাধারণ মানুষকে  ডোনার হিসেবে ভারতে নিয়ে গেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনপ্রত্যাশীর কাছ  থেকে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা নিলেও কিডনি দানকারীর সঙ্গে চুক্তি করত তারা ৬-৭ লাখ টাকা। শুরুতে লাখ দুয়েক টাকা দিলেও চুক্তি অনুযায়ী বাকি টাকা দিতে শুরু করত নানা টালবাহানা। মাঝেমধ্যে টাকা চাইলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দিত ভুক্তভোগী কিডনি দাতাদের। কিডনি চক্রের দুর্বৃত্তরা শুধু ঢাকাতেই নয়, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটসহ সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, ২০১১ সাল থেকে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বহুতি গ্রামসহ আরও অন্তত ৩৩টি গ্রামে কিডনি কেনাবেচার অপতৎপরতা চলছে। তবে বিভিন্ন সময় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে এই অপতৎপরতা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হলেও খুব একটা সফলতা আসেনি। এর পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও তাদের এ পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করেছে। শুধু জয়পুরহাটের ৩৩ গ্রামের ৩৩৭ জন অভাবী মানুষ গত ১১ বছরে তাদের একটি করে কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কিডনি কারবারের মতো স্পর্শকাতর ঘটনায় দীর্ঘদিন ধরে জয়পুরহাট ছাড়াও ফরিদপুরের একাধিক চক্র জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে এই অপরাধীরা সারা দেশে সক্রিয় রয়েছে। করোনার মধ্যেও তারা কিডনি নিয়ে বাণিজ্য করছে। তদন্তে একাধিক চক্রের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে র‌্যাবের অভিযানে তাদের অনেকে ধরা পড়েছে। যারা ধরা পড়েনি তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর