‘১১ জন নিহতের জানাজায় মানুষের ঢল নেমে এসেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের শোকের ছায়া দৃশ্যমান হয়েছে জানাজাস্থলে। জানাজায় উপস্থিত হয়ে অধিকাংশ মানুষ এ শোক ধরে রাখতে পারেননি। একসঙ্গে এত তরুণের মৃত্যু কেউই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। এ দুর্ঘটনায় অন্যদের মতো আমি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে হারালাম’- আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন নিহত জিসানের বন্ধু এহসানুল হক আবিদ। মিরসরাইয়ের ট্রেন-মাইক্রোবাস মুখোমুখি সংঘর্ষের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত ১১ তরুণের পৃথকভাবে জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজার এলাকার খন্দকিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঁচজনের জানাজা সম্পন্ন হয়। বাকি ছয়জনের জানাজা সম্পন্ন হয় নিজ নিজ এলাকায়। এর আগে নিহত তরুণদের জানাজার মাঠ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। জানাজায় সমবেত হতে বিভিন্ন এলাকার মানুষ সেখানে আসতে শুরু করেন। জানাজায় অংশ নিয়েছেন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ সাধারণ মানুষ। এর আগে ওই তরুণদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স মাঠে এসে পৌঁছালে মানুষ তাদের শেষবারের মতো দেখার চেষ্টা করে। এই পাঁচজনের জানাজায় ইমামতি করেন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ আল্লামা সৈয়দ অছিয়র রহমান। নিহত সবার বাড়ি উপজেলার ছিকনদণ্ডী ইউনিয়নে। এ ছাড়া বেলা সাড়ে ১১টায় নজুমিয়া স্কুলমাঠে আরও চারজনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে নিহত মারুফ ও জিসানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় শুক্রবার রাতে। পরে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে শুক্রবার রাতে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে মৃতদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে জানান হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীদুল আলম। স্থানীয় বাসিন্দা আমিন মুন্না বলেন, মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় প্রিয়জনদের হারিয়ে স্বজনদের বাড়িতে বাড়িতে চলছে এখন শোকের মাতম। স্বজনহারাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে বাতাস। পুরো এলাকাজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। নিহতদের স্বজনরা দুর্ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। খন্দকিয়া গ্রামের যুগীরহাট বাজার এলাকার মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তফা নিরুর (২৬) বাড়ি। স্বামীর দাফন হয়েছে, কন্যা রুহি আক্তারকে বুকে জড়িয়ে রেখে কান্না থামছে না স্ত্রী রুপা আক্তারের। পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল তাদের। পুত্র শোকে কাঁদছেন গোলাম মোস্তফার বাবাও। মা শাহনাজ আক্তারের অন্যত্র বিয়ে হলেও বাড়ির পাশে নিহত ইকবাল হোসেনের নানার বাড়ি। মায়ের সঙ্গে এখানেই কেটেছিল শৈশব-কৈশোর। সে কে এস নজুমিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। সেখানেও ভিড় করে মানুষ। খন্দকিয়া গ্রামের আবদুল লতিফ মাস্টারের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। ওমরগণি এমইএস কলেজে গণিত দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জিয়াউল হক সজীব কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। কিছুক্ষণ পর পর নিজের বুক চাপড়াচ্ছেন মা শাহনাজ আক্তার। বলছেন, ‘আমার মাস্টার সজীব কই!’ বাবা আবদুল হামিদ সন্তান হারিয়ে বাকরুদ্ধ।

সেই গেটম্যান সাদ্দাম কারাগারে : মিরসরাইয়ে ১১ জন নিহতের ঘটনায় গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন। এর আগে চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) জহিরুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। অবহেলাজনিত কারণে হত্যার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়। এ ছাড়া দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সাদ্দামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

তদন্ত রিপোর্ট শিগগিরই : মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা কাজ করছেন। ইতোমধ্যে কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থলেও গেছেন। দুর্ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখসহ সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই শিগগিরই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবেন বলে জানান চট্টগ্রাম বিভাগীয় তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) মো. আনছার আলী। প্রসঙ্গত, শুক্রবার মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া এলাকায় ট্রেন-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় ১১ জন নিহত হন। এ ঘটনায় ৯ জন আহত হয়েছেন।