শনিবার, ৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীনের আট পদক্ষেপ ঘোষণা

উত্তেজনা তীব্র হচ্ছে তাইওয়ান ঘিরে

প্রতিদিন ডেস্ক

উত্তেজনা তীব্র হচ্ছে তাইওয়ান ঘিরে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর কেন্দ্র করে নতুন আট পদক্ষেপ নিয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের দ্বীপক্ষীয় তিনটি আলোচনা বাতিল এবং পাঁচটি আলোচনা ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা চুক্তি স্থগিত করেছে চীন। এদিকে তাইওয়ান ঘিরে চীনের সর্বাত্মক সামরিক মহড়ার সময় অন্তত পাঁচটি চীনা ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র জাপানের জলসীমার এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক জোনে আঘাত হেনেছে। একইভাবে ১১টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র তাইওয়ানের নিকটবর্তী জলসীমায় আঘাত হেনেছে। এমন পরিস্থিতিতে তাইপে থেকে বিমানের বেশ কয়েকটি ফ্লাইট বাতিল করা হয়। একই সঙ্গে নিরাপত্তার কারণে বহু বিদেশি বিমান সংস্থা পরিহার করছে তাইওয়ানের ‘এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল’ (এটিসি) নিয়ন্ত্রিত আকাশপথ। এদিকে ন্যান্সি পেলোসি দক্ষিণ কোরিয়া সফর শেষে এখন জাপানে রয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়া সফরের সময়ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এ সফরের সময় থেকে পিয়ংইয়ং তাদের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোকে সক্রিয় করে রেখেছে। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, আলজাজিরা, এএফপি, গ্লোবাল টাইমস, সিজিটিএন, জাপান টাইমস। প্রাপ্ত খবর  অনুযায়ী, মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করলে তার ‘ফল ভালো হবে না’ বলে আগেই সতর্ক করেছিল চীন। তার পরও তাইওয়ান সফর করেছেন ন্যান্সি। তার পরই কার্যত তাইওয়ান ঘিরে ধরে ভয়াবহ সামরিক মহড়া শুরু করেছে চীন। চীনের দাবি, রুটিন সামরিক মহড়া চলছে। কিন্তু যেভাবে তারা এ মহড়া শুরু করেছে তাতে চিন্তিত তাইওয়ান। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বেলা ১২টায় চীন আনুষ্ঠানিকভাবে মহড়া শুরু করে। জল, স্থল ও আকাশে মহড়া চলছে। একের পর এক যুদ্ধবিমান তাইওয়ান প্রণালির ওপর দিয়ে তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে উড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধজাহাজ কার্যত ঘিরে রেখেছে তাইওয়ানকে। তাইওয়ানের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে যুদ্ধজাহাজ রাখা হয়েছে। নৌ ও স্থল সেনারা লাগাতার গোলা ছুড়ছে। একের পর এক ব্যালাস্টিক মিসাইলও তাইওয়ান প্রণালিতে সমুদ্রের পানিতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। ওয়াকিবহালরা বলছেন, সামান্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেই ক্ষেপণাস্ত্র তাইওয়ানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে পারে। মহড়ায় নেমেছে চীনের স্থলসেনাও। চীন লিবারেশন আর্মি অবশ্য জানিয়েছে, এটি তাদের রুটিন মহড়া। মূল ভূখণ্ড থেকেও সমুদ্র লক্ষ্য করে মিসাইল ছোড়া হচ্ছে। তাইপেই জানিয়েছে, তাইওয়ানের ওপর দিয়ে মিসাইল ছুড়ছে চীন। তাইওয়ান পার করে যা পানিতে গিয়ে পড়ছে। ফলে গোটা তাইওয়ানে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। গতকালের প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, চীনের ছোড়া পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র জাপানের সমুদ্রসীমার একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন-ইইজেড) আঘাত হেনেছে বলে অভিযোগ করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী নোবুও কিশি। তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, পাঁচটি মিসাইল তাদের ইইজেডে আঘাত হেনেছে। তিনি বলেন, ‘চীনের পাঁচটি মিসাইলই আমাদের ইইজেডে পড়েছে, যা জাপান উপকূলের ২০০ নটিক্যাল মাইলের (৩৭০ কিলোমিটার) মধ্যে। মিসাইলগুলো ওকিনাওয়া অঞ্চলের হাতেরুমা দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের পানিতে পড়েছে।’ জাপানের জাতীয় ও জনগণের নিরাপত্তার জন্য এটি বড় উদ্বেগের বিষয় বলে দাবি করেন মন্ত্রী।

এদিকে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব সাগরে অনেক ডংফেং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। মাতসু দ্বীপের কাছেও দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে চীন। গতকাল মহড়ার আওতায় কমপক্ষে ১১টি ক্ষেপণাস্ত্র তাইওয়ানের রাজধানী তাইপের ওপর দিয়ে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে চীনা বাহিনী। তবে সেগুলো বায়ুমণ্ডল দিয়ে উড়ে যাওয়ায় সরাসরি কোনো হুমকি সৃষ্টি করেনি।

এদিক তাইওয়ানের প্রধানমন্ত্রী সু সেং-চাং বলেন, ‘চীন নির্বিচারে সামরিক মহড়া চালিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত জলপথ ধ্বংস করে দিচ্ছে।’ এ সময় তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে ‘দুষ্ট প্রতিবেশী’ হিসেবে আখ্যা দেন। সু সেং-চাং বলেন, ‘একাধিক প্রতিবেশী দেশ ও গোটা বিশ্ব চীনের আচরণের নিন্দা করছে।’

আরেক খবরে বলা হয়, চীনা বিমানবাহিনীর যুদ্ধ মহড়ার কারণে বিভিন্ন দেশের অসামরিক উড়োজাহাজ তাইওয়ানের আকাশপথে ঢুকতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে বহু বিমান সংস্থা তাদের তাইওয়ানের ফ্লাইট বাতিল করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান সংস্থা তাদের গতকালের ও আজকের তাইপে ফ্লাইট বাতিল করেছে। পাশাপাশি এশিয়া ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আকাশপথ পরিবর্তন করেছে। তারা বলছে, নিরাপত্তার কারণে পরিহার করা হচ্ছে তাইওয়ানের ‘এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল’ (এটিসি) নিয়ন্ত্রিত আকাশপথ। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস জানিয়েছে, তাইওয়ানের সতর্কবার্তা পেয়েই আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে ফ্লাইট। এদিকে তাইওয়ানও গতকাল তাদের বেশ কয়েকটি নিয়মিত ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে তাইপের শোংশান বিমানবন্দর থেকে এক এক করে বিদেশি বিমান মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

চীনের আরও আট পদক্ষেপ : গতকাল চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, পেলোসির তাইওয়ান সফরের প্রতিবাদে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক কমান্ডারদের মধ্যকার আলোচনা, প্রতিরক্ষানীতি সমন্বয় আলোচনা (ডিপিসিটি) ও নৌসীমা নিয়ে সামরিক পরামর্শ চুক্তি (এমএমসিএ)-সংক্রান্ত সভা বাতিল করেছে চীন। এ তিন সভা বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে আরও পাঁচটি আলোচনা, চুক্তি ও সহযোগিতা কার্যক্রম স্থগিত করেছে চীন। চীন-যুক্তরাষ্ট্র অবৈধ অভিবাসনসংক্রান্ত সহযোগিতা, অপরাধসংক্রান্ত বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আইনি সহায়তা কার্যক্রম, উভয় দেশে সংঘটিত অপরাধ দমনসংক্রান্ত সহযোগিতা কার্যক্রম, আন্তদেশি মাদকবিরোধী সহযোগিতা কার্যক্রম ও চীন-যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু আলোচনা স্থগিত করেছে চীন। একই সঙ্গে ন্যান্সি পেলোসি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির কথা জানায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, চীনের গভীর উদ্বেগ ও কঠোর বিরোধিতা সত্ত্বেও ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়েছেন এবং একই সঙ্গে চীনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক একাগ্রতা হুমকির মুখে ফেলেছেন। এর মাধ্যমে ‘এক চীন’ নীতি ভাঙা হয়েছে এবং এটি তাইওয়ান প্রণালি অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি।

দুই কোরিয়ার মধ্যে উত্তেজনা : ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর ঘিরে কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে তাইওয়ান সফর শেষে বুধবার তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছান। বৃহস্পতিবার তিনি কোরীয় সীমান্তের সুরক্ষিত ডিমিলিটারাইজড জোন (ডিএমজেড) পরিদর্শন করেন। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল তাঁর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করেননি।

দক্ষিণ কোরিয়ার একজন কর্মকর্তা বলেন, পেলোসি বুধবার রাতে সিউলে পৌঁছানোর পর জাতীয় পরিষদের স্পিকার কিম জিন-পিওসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন তিনি পারমাণবিক ক্ষমতাধর উত্তর কোরিয়ার সীমান্তের ডিএমজেড এলাকায় যান। তিনি আলোচিত পানমুনজাম ও জয়েন্ট সিকিউরিটি এরিয়া পরিদর্শন করেন। ২০১৯ সালের পর সর্বোচ্চ পদধারী মার্কিন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সেখানে যান। খবরে বলা হয়, ওই সীমান্তে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সেনারা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। পেলোসির সফর কেন্দ্র করে উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো সক্রিয় রাখে।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন ছুটিতে থাকায় পেলোসির সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করেননি। তবে ৪০ মিনিট টেলিফোনে পেলোসির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ নিয়ে নানা সমালোচনাও শুরু হয়েছে। মার্কিন সূত্রগুলো এ সাক্ষাৎ না করার বিষয়টিকে ‘অপমান’ হিসেবে দেখছেন।

এদিকে পেলোসির সফরকে ইঙ্গিত করে চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র উত্তর কোরিয়া বলেছে, ‘তাদের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ধরনের সমালোচনা সহ্য করা হবে না। কোনো দেশকে নিজেদের সার্বভৌম অধিকার লঙ্ঘন করতে দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে আঘাত হানতে প্রস্তুত উত্তর কোরিয়া।’ এ ছাড়া গতকাল প্রকাশিত জাতিসংঘের গোপন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে উত্তর কোরিয়া আরও বেশি করে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। এজন্যই পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত রেখেছে তারা। পেলোসির দক্ষিণ কোরিয়া সফরের মধ্য দিয়ে এ পরীক্ষা প্রস্তুতি নতুন মাত্রা পেয়েছে।

পেলোসি এখন জাপানে : এশিয়া সফরের শেষ পর্যায়ে পেলোসি এখন জাপানে। বৃহস্পতিবার টোকিওর ইয়োকোটা বিমানঘাঁটিতে অবতরণের পর জাপানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলিঙ্গন ও করমর্দন করেন পেলোসি। গতকাল সকালে তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তাঁদের আলোচনার কেন্দ্রে ছিল তাইওয়ান। জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে বৈঠক ও নাশতা করেন মার্কিন স্পিকার। এ সময় তাঁরা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন।

চীনের রাষ্ট্রদূতের কাছে ব্যাখ্যা চাইল হোয়াইট হাউস : তাইওয়ান ঘিরে চীনের সামরিক মহড়ার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ব্যাখ্যা চেয়েছে হোয়াইট হাউস। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার তাঁকে ডাকা হয়। খবর ওয়াশিংটন পোস্ট ও বিবিসির।

গণমাধ্যমকে দেওয়া হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, ‘রাতভর চীনের মহড়ার পর, চায়নার (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না) রাষ্ট্রদূত কিন গ্যাংকে হোয়াইট হাউসে ডেকে পাঠানো হয়। তাদের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তাঁকে ব্যাখ্যা জানাতে এ তলব করা হয়।’ কিরবি বিবৃতিতে আরও জানিয়েছেন, বাইডেন প্রশাসন চীনের এই সামরিক মহড়ার নিন্দা জানিয়েছে। ‘যা দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং তাইওয়ান প্রণালিজুড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য আমাদের দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

সর্বশেষ খবর