জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বেড়ে গেছে বাস ভাড়া। এতে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া যাত্রীদের কয়েক গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। বাসগুলোতে এখনো মূল্য বৃদ্ধির তালিকা টানানো হয়নি। এ সুযোগে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন পরিবহন শ্রমিকরা। এ নিয়ে রাজধানীর বেশির ভাগ গণপরিবহনেই চালক ও কন্ডাকটরের সঙ্গে যাত্রীদের বাগ্বিতন্ডা হচ্ছে। একই অবস্থা চট্টগ্রামসহ অন্য মহানগর ও জেলা শহরগুলোতে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দখল ও বিক্ষোভ করেছেন। এদিকে লঞ্চের ভাড়া পুনর্নির্ধারণে লঞ্চ মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে আজ বৈঠকে বসবেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বাসভাড়া পুনর্নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি : জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর বাস ও মিনিবাসের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সিটি সার্ভিসে কিলোমিটারে যাত্রী প্রতি ৩৫ পয়সা আর দূরপাল্লায় ৪০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। গতকালই নতুন ভাড়া কার্যকর হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৩৪ (২) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর গত শনিবার রাতে বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে দীর্ঘ বৈঠকে বাস-মিনিবাসের ভাড়া সিটি সার্ভিসে কিলোমিটারে যাত্রী প্রতি ৩৫ পয়সা আর দূরপাল্লায় ৪০ পয়সা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। গতকাল ভাড়া বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি সর্বোচ্চ ভাড়া ১ টাকা ৮০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ২০ পয়সা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটার যাত্রী প্রতি ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী মিনিবাস এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আওতাধীন জেলার (নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা) অভ্যন্তরে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি ভাড়া ২ টাকা ০৫ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৪০ পয়সা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভাড়া যথাক্রমে ১০ টাকা ও ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
রাজধানীতে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় : রাজধানীর মেরাদিয়া থেকে অফিসের কাজে প্রতিদিনই মৌচাক যাতায়াত করেন মোস্তফা কামাল। অন্যান্য দিনের মতো গতকাল সকালে স্বাধীন পরিবহনে ওঠেন তিনি। একটু যেতেই কন্ডাকটর ভাড়া নিতে এলেন। প্রতিদিনের মতো ভাড়া দিলেন ২০ টাকা। কন্ডাকটর বললেন ভাড়া ৩০ টাকা। কীভাবে এত টাকা হয় জানতে চাইলে কন্ডাকটর বলেন, ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। মোস্তফা কামাল বলেন, তাই বলে ১০ টাকা বেড়েছে! পুরান ঢাকার খোরশেদ আলম জরুরি কাজে ফার্মগেটে এসেছেন। অন্য সময়ের মতো গতকাল সকালে এই রুটের বাস তানজিল পরিবহনে উঠতে যেতেই কন্ডাকটর জানিয়ে দিলেন ভাড়া ২৫ টাকা। অথচ এই রুটে এত দিন ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে চলাচল করতেন তিনি। তাই কন্ডাকটরের বাড়তি ভাড়ার কথা শুনে অনেকটা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এই যাত্রী। সঙ্গে আরও কয়েকজন যোগ দেন। কারণ এ বাসে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত আগে ৪০ টাকা ভাড়া নেওয়া হলেও গতকাল চাওয়া হয় ৫০ টাকা। যদিও ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে মিরপুরের চিড়িয়াখানা পর্যন্ত দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার থেকে একটু বেশি। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবে মোট ভাড়া হয় ৩৮ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু করোনা ও নভেম্বরে তেলের দাম বাড়ার পর থেকেই ভাড়া নেওয়া হতো ৪০ টাকা করে।
বেশি ভাড়া নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাসটির কন্ডাকটর সেলিম হোসেন বলেন, ‘মালিক নিতে বলছেন, তাই নিতেছি।’ এভাবে ইচ্ছামতো ভাড়া কাটা নিয়ে গতকাল যাত্রীদের সঙ্গে বেশির ভাগ বাসেই বাগ্্বিতন্ডার ঘটনা ঘটেছে।কোনো বাসে নেই ভাড়ার তালিকা : নিয়ম অনুযায়ী নতুন করে ভাড়া নির্ধারণের পর সড়কে বাস নামলে তাতে ভাড়ার তালিকা থাকার কথা। কিন্তু নতুন ভাড়া নির্ধারণের পরদিন গতকাল সড়কে ১০টি রুটের একাধিক গাড়িতে উঠে দেখা গেছে কোনোটাতেই তালিকা নেই। এমনকি পুরনো তালিকাও তুলে ফেলা হয়েছে।
গাজীপুর রুটের আজমেরী, টঙ্গী-গাজীপুরা রুটের ভিক্টর পরিবহন, সাভার রুটের সাভার পরিবহন, মিরপুর রুটের বিহঙ্গ ও তানজিল পরিবহন, মিডলাইন, ট্রান্স সিলভা পরিবহন, নগর পরিবহনের একাধিক গাড়িতে উঠে দেখা গেছে কোনোটায় নতুন ভাড়ার তালিকা নেই। এমনকি রাষ্ট্রীয় পরিবহন বিআরটিসির বাসেও এখনো লাগেনি ভাড়ার তালিকা। একাধিক বাসের শ্রমিকরা বলেছেন, এখনো মালিকদের পক্ষ থেকে ভাড়ার তালিকা কবে দেওয়া হবে সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
যদিও বিআরটিএ এবং বাস মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাড়তি ভাড়া নিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিআরটিএর পক্ষ থেকে গতকাল রাজধানীতে ১০টি টিম কাজ করেছে দাবি করা হলেও গুলিস্তান-পল্টন-প্রেস ক্লাব থেকে শাহবাগ এলাকায় কোনো অভিযান দেখা যায়নি। তবে বিআরটিএর পক্ষ থেকে বিমানবন্দর এলাকায় অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজিদ আনোয়ার বলেন, ‘কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ৫০ পয়সার বেশি ভাড়া নেওয়া যাবে না। যারা নেবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ ভাড়ার তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বাসে অন্তত চারটি জায়গায় ভাড়ার তালিকা থাকতে হবে। নইলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এদিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন জেলা শহরেও যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
সাভার : জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে সাভার ও আশুলিয়ার পরিবহন ভাড়া। বাড়তি ভাড়া নেওয়া হলেও সাভারে বিভিন্ন জায়গায় গণপরিবহন সংকটে পড়েছেন মানুষ। আবার কোথাও কোথাও সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত আদায় করা হয়েছে। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে পরিবহন শ্রমিকদের। এমনকি হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটেছে। গতকাল সকালে সাভারে আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
গাজীপুর চন্দ্রা থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত চলে ইতিহাস পরিবহনের বাস। এ বাসে উঠলে দেখা যায়, নির্ধারিত নতুন ভাড়ার চেয়ে ৫ টাকা বেশি নিচ্ছেন কন্ডাকটর। এ নিয়ে হেলপারের সঙ্গে যাত্রীদের কথাকাটাকাটিও হয়েছে। এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ১টায় মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বর থেকে শুরু হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ঘুরে আবার মুরাদ চত্বরে এসে শেষ হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা প্রায় আধঘণ্টা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন।
খুলনা : জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে খুলনার সব রুটে পরিবহনের বাড়তি ভাড়া ইচ্ছামতো আদায় করা হচ্ছে। খুলনা থেকে সাতক্ষীরার দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। এ রুটে ১১০ টাকার ভাড়ার স্থলে আদায় করা হচ্ছে ১৫০ টাকা। একই দূরত্বের খুলনা-যশোর রুটেও ১১০ টাকার বদলে আদায় করা হচ্ছে ১৫০ টাকা। এ ছাড়া খুলনা-কুষ্টিয়া রুটে ২৮০ টাকার স্থলে ৩৫০ টাকা, খুলনা-মেহেরপুর রুটে ৩০০ টাকার স্থলে ৪০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। ইচ্ছামতো পরিবহন ভাড়া আদায়ে বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা। গতকাল সরেজমিন খুলনার সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে গেলে যাত্রীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা যায়।
রাঙামাটি : জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর রাঙামাটিতে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৫২ শতাংশ। গতকাল রাঙামাটি জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে এ বিষয়ে জরুরি সভা শেষে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
এ ছাড়া বগুড়া, লালমনিরহাট ও রাজশাহীতে ভাড়ানৈরাজ্য লক্ষ্য করা গেছে।
লঞ্চ ভাড়া পুনর্নির্ধারণে বৈঠক আজ : বাসের পর এবার লঞ্চ ভাড়া পুনর্নির্ধারণে লঞ্চ মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আজ সোমবার বেলা ১২টায় সচিবালয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।