মঙ্গলবার, ৯ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

ভাড়া নৈরাজ্যের চাপে মধ্যবিত্ত

প্রতিদিনই বাগবিতণ্ডা যাত্রীদের সঙ্গে, পণ্য পরিবহনে দাম বৃদ্ধিতে বাজারেও উত্তাপ

বিশেষ প্রতিনিধি

গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে ভয়াবহ চাপে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ। একসঙ্গে যাতায়াত ভাড়া এবং নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। শুক্রবার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন থেকেই সারা দেশে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু সেই বাড়তি ভাড়াও অনেক পরিবহন মালিক-শ্রমিক মানতে চান না। সারা দেশে যথেচ্ছ হারে ভাড়া আদায়ের কারণে প্রতিদিনই বিভিন্ন রুটে পরিবহন কর্মীদের সঙ্গে যাত্রীদের বাগবিতণ্ডা হচ্ছে। এদিকে পণ্য পরিবহন ভাড়া বাড়ায় বাজারে নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। যাত্রী পরিবহন ভাড়া এবং বাজারের উত্তাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। তারা অন্য খাতের খরচ কমিয়ে বাড়তি ব্যয়ের ভার লাঘবের চেষ্টা করছেন।  এর আগে গত শুক্রবার রাতে লিটারপ্রতি ডিজেল ৮০ টাকা থেকে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, কেরোসিন ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোল ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার রাতে গণপরিবহনের ভাড়া ১৬-২২ শতাংশ বাড়িয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এতে নগর পরিবহনে বাস ও মিনিবাসে ভাড়া ৩৫ পয়সা, দূরপাল্লায় বাস ভাড়া ৪০ পয়সা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ফলে দূরপাল্লার বাসে ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ২.২০ টাকা, মহানগর পর্যায়ে কিলোমিটারে বাসে ২.৫০ টাকা, মিনিবাসে ২.৪০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। ফলে নগরীতে দূরত্বভেদে ৫ থেকে ১৫ টাকা এবং দূরপাল্লায় ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বেড়ে গেছে। কোনো কোনো পরিবহন এর চেয়েও বেশি ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছে। এই বাড়তি ভাড়ার চাপ সামাল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অন্যদিকে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানসহ পণ্য পরিবহনের ভাড়া সরকারিভাবে নির্ধারণ করা না হলেও সারা দেশে পণ্য পরিবহন ভাড়াও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়েছে। নৌপথের ভাড়া দ্বিগুণ হারে বাড়ানোর জন্য লঞ্চ মালিকরা গত দুই দিন ধরে সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন সরকারি ভাড়ার তালিকা লঙ্ঘন করে যারা বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর মনিটরিং জোরদার করতে হবে। 

রাইদা পরিবহনকে জরিমানা : রাজধানীর পোস্তগোলা-দিয়াবাড়ী রুটে চলাচলকারী রাইদা পরিবহনের একটি বাসকে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। যাত্রীর কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেওয়ায় গতকাল রামপুরায় বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খোশনুর রুবাইয়াৎ বাসটিকে এ জরিমানা করেন। তিনি বলেন, ভাড়া তদারকিকালে রাইদা পরিবহনের একটি বাস থামানো হলে যাত্রীরা বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেন। দেখা যায়, বাসে নতুন ভাড়ার তালিকাও প্রদর্শিত হয়নি। পরে বাসটিকে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া সেখান থেকে অতিরিক্ত আদায়কৃত অর্থ যাত্রীদের ফেরত দেওয়া হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট আরও বলেন, সারা দিন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও নতুন ভাড়ার তালিকা প্রদর্শনের বিষয়টি তদারকি করা হয়।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়েছে অসহনীয় পর্যায়ে। নতুন হার অনুযায়ী, দূরপাল্লার বাসে প্রতি কিলোমিটারে ৪০ পয়সা বেড়ে ২ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে একলাফে টিকিট প্রতি বাড়ানো হয়েছে ২০ টাকা। ৪৫ টাকার টিকিট এখন ৬৫ টাকা। এতে জেলার বাসের যাত্রীরা চরম হতাশা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী বন্ধন ও উৎসব পরিবহনের ভাড়া ৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৫ টাকা, শীতল পরিবহনের ৬৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা, বিআরটিসি ৪০ টাকা থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে ৫০ টাকা ও হিমাচল পরিবহন ও আনন্দ পরিবহন ১০ টাকা বাড়িয়েছে। তবে বন্ধু পরিবহন নারায়ণগঞ্জ-চিটাগাং রোডে আগের ভাড়া ২৮ টাকাই চলাচল করছে। এ নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

ঢাকায় প্রতিদিন যাতায়াতকারী শহরের মিশনপাড়া এলাকার চাকরিজীবী মোহসিন মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জুলুমের শেষ আছে। এটা সম্পূর্ণ জুলুম আমাদের মতো মধ্যবিত্তের ওপর। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা যাতায়াতকারী বঙ্গ মার্কেটের দোকানি সামাদ কবীর জানান, ইচ্ছামতো বাসের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকরা। তাদের কিছু বলাও যাচ্ছে না। আমার তো বেতন-ভাতা বাড়েনি। আমাদের কী হবে। কেউ তো কোনো কিছু আলাপও করল না।

নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে নোয়াখালীতে আঞ্চলিক সড়ক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রুটে এবং ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দূরপাল্লার বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে চলে বাগবিতণ্ডা। নোয়াখালী থেকে ঢাকাগামী নন-এসি বাসে আগে ৪০০ টাকার ভাড়ার স্থলে গত দুই দিন থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে এবং এসি বাসে ৪৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

বাড়তি ভাড়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। একলাফে ১০০ টাকা ভাড়া বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক মনে করছেন যাত্রীরা। জেলার কোথাও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রুটে এবং ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দূরপাল্লার বাস কাউন্টারগুলোতে সরকার নির্ধারিত নতুন ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে বিআরটিএ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বা জেলা প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, বরিশালে লঞ্চ-বাসে ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য চলছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর লঞ্চে ভাড়া পুনর্নির্ধারিত না হলেও স্থানীয় বিভিন্ন রুটে ২০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বেড়েছে। আগে ঢাকাগামী লঞ্চে সরকার নির্ধারিত রেটের চেয়ে কম ভাড়ায় ডেক যাত্রী পরিবহন করলেও এখন সিন্ডিকেট করে পূর্ব নির্ধারিত সাড়ে ৩০০ টাকাই আদায় করছে তারা। অন্যদিকে সড়ক পরিবহনে সরকার দূরপাল্লা রুটে কিলোমিটার প্রতি ৪০ পয়সা ভাড়া বাড়ালেও আদায় হচ্ছে আরও বেশি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। ভাড়া বৃদ্ধির নানা অজুহাত দিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে যশোরের শার্শা ও বেনাপোলে যাত্রী এবং পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার ঘটনা ঘটছে। বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ যাত্রীদের। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষকরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। আমন আবাদ ব্যাহতের আশঙ্কা চাষিদের। বেনাপোল যশোর ও ঢাকা মহাসড়কে যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার থেকেও বেশি নিচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা। ফলে যাত্রীদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার সৃষ্টি হচ্ছে। নিম্নআয়ের মানুষ ও চাকরিজীবীরাও পড়ছেন সমস্যায়।

লঞ্চ ভাড়া দ্বিগুণের দাবি অযৌক্তিক : নৌ সচিব

 

সর্বশেষ খবর