মঙ্গলবার, ৯ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস

জ্বালানি অনুসন্ধানে গতি নেই

♦ সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে দুই যুগেও আকৃষ্ট করা যায়নি বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ♦ আমদানিনির্ভরতা কমাতে সুপরিকল্পিত অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

জিন্নাতুন নূর

জ্বালানি অনুসন্ধানে গতি নেই

দেশের জ্বালানি অনুসন্ধান কার্যক্রমে গতি না থাকায় সংকটে পড়েছে  জ্বালানি খাত। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে প্রাকৃতিক গ্যাস। একমাত্র কয়লাখনির মজুদও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আমদানিনির্ভর জ্বালানি দিয়ে চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। এতে টান পড়ছে রিজার্ভে। জ্বালানি সংকটে দিতে হচ্ছে বাধ্যতামূলক লোডশেডিং। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রাথমিক জ্বালানি অনুসন্ধানে এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। জ্বালানি সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের দেশীয় উৎসের কাছেই ফিরে যেতে হবে। এ জন্য যত সময়ই লাগুক তা সরকারকে দিতে হবে। তা না হলে সংকট উত্তরণ হবে না। আমদানিনির্ভরতা কমাতে হলে সুপরিকল্পিতভাবে জ্বালানি অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে হবে। এ পরিস্থিতিতে আজ দেশব্যাপী পালিত হবে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস।

গবেষণা বলছে, দেশের স্থল ও জলভাগে আরও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এখনো স্থলভাগের অনেকাংশ অনুসন্ধানের আওতায় আনা যায়নি। জলসীমায়ও সে অর্থে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পরও বাংলাদেশ দীর্ঘ সময়ে সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে সে অর্থে সুখবর দিতে পারেনি। সাগরে আমাদের পাশের সীমানা থেকে মায়ানমার গ্যাস উত্তোলন করছে, অন্যদিকে অশোকনগরে তেল আবিষ্কার করেছে ভারত। জ্বালানি অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অনেকটাই অবহেলিত থেকে গেছে। যদিও ভোলা নর্থগ্যাস ফিল্ড ও মোবারকপুরের মাঝামাঝি শরীয়তপুরে নতুন কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লি. (বাপেক্স) কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) সবশেষ তথ্যে, প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের বিপরীতে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০২২ সালে যেখানে গ্যাসের ঘাটতি প্রায় ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট, ২০৩০ সালে তা ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটে পৌঁছতে পারে। গত ২০ বছরে প্রায় ১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে বাংলাদেশ মাত্র ২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কনোকো ফিলিপসকে দায়িত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়েই আমাদের গভীর সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। কিন্তু অনেক কিছু বহুজাতিক কোম্পানিটির মনমতো না হওয়ায় তারা কিছু জিনিস রিভিশন চেয়েছিল। কিন্তু তা না হওয়ায় তারা চলে যায়। এরই মধ্যে ভারতীয় একটি কোম্পানি কাজ করছে। অর্থাৎ সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম যে বন্ধ আছে তা নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধাক্কা খেয়ে কাজ হয়তো কিছুটা পিছিয়েছে। কয়লার ক্ষেত্রে বড়পুকুরিয়া ছাড়া অন্যগুলোর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়নি। বর্তমান বৈশ্বিক সংকট আমাদের আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিল জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের নিজস্ব রিসোর্স নিশ্চিত করতে হবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটি সত্য যে, দেশের জ্বালানি অনুসন্ধান কার্যক্রমে কোনো গতি নেই। দুই দশকের বেশি সময় ধরে যে পরিমাণ জ্বালানি অনুসন্ধান করার কথা সরকারের ছিল তা করা হয়নি। আমাদের দেশ অনেক সম্ভাবনাময় আর জ্বালানি অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হলে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। তখন আমাদের স্পট মার্কেট থেকে আর উচ্চমূল্যে এলএনজি কিনতে হতো না। আর অনুসন্ধান না চালানোর ফলে গ্যাসের উৎপাদন অনেক কমে গেছে এবং এটি ভবিষ্যতে আরও কমে আসবে বলে পেট্রোবাংলা ধারণা করছে। ফলে সামনে আরও বড় বিপদ আসছে। অনুসন্ধানের বদলে আমরা যখন এলএনজি আমদানিতে গেলাম তখন এলএনজির দাম অনেক বেড়ে গেছে। ফলে আমরা এখন বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছি। আমাদের অবহেলাজনিত কারণে এ সংকট তৈরি হতে হতে তা অনেক গভীরে পৌঁছে গিয়েছিল। তখন আমরা এ সমস্যা সমাধানের জন্য এলএনজিতে গিয়েছি কিন্তু এলএনজির দাম উল্টো বৃদ্ধি পেয়েছে যা সংকট তৈরি করেছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের দেশীয় উৎসের কাছেই আসতে হবে। এ জন্য যত সময় লাগবে লাগুক। এ ছাড়া সংকট উত্তরণ হবে না।

কয়লায় অগ্রগতি নেই : বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প ছাড়া অন্য খনিজসম্পদ উত্তোলনে কোনো উদ্যোগ ও কার্যক্রম নেই। এদিকে বড় পুকুরিয়া থেকে সর্বোচ্চ আর পাঁচ থেকে ছয় বছর কয়লা উত্তোলন করা যেতে পারে। সরকারি তথ্যে, দেশে কয়লাখনি রয়েছে পাঁচটি। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, রংপুরের খালাসপীর, জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ও দিনাজপুরের দীঘিপাড়া। এগুলোতে মোট ৭ হাজার ৯৬২ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো হয়। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়।

অথচ এশিয়ার সব থেকে উন্নত কয়লা পাওয়া যাওয়ার কথা রংপুরের পীরগঞ্জের মদনখালী কয়লাখনিতে। কিন্তু এ কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ ঝুলে আছে বছরের পর বছর। জানা যায়, মদনখালীর জন্য কয়লা উত্তোলন পলিসি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সরেজমিন ঘুরেও এসেছেন। কিন্তু এরপর কোনো অগ্রগতি নেই। এ কয়লা খনির বিষয়ে ২০০৬ সালে সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা পড়ে। এতে বলা হয়, এ খনি থেকে ১০ বছরে প্রতি বছর ৪ মিলিয়ন টন করে কয়লা উত্তোলন করা যাবে। কিন্তু এ জায়গা থেকে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। অথচ দেশের বিদ্যুৎ খাতের নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলোর অনেকগুলোই কয়লাভিত্তিক। পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, দেশীয় চাহিদা মেটাতে বড়পুকুরিয়া ছাড়া অন্য কোথাও থেকে কয়লা তোলা যায় কি না তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। মদনখালী কয়লাখনির বিষয়ে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। 

সমুদ্রে থমকে আছে অনুসন্ধান : মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল তা মিটে যায় ২০১২ সালে। কিন্তু তার পর এত বছরেও বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা হয়নি। সমুদ্রে মাত্র একটি ব্লকে ভারতীয় একটি কোম্পানি জরিপ এবং অনুসন্ধানের কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন অংশীদারিত্বের চুক্তির ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্য যথাযথ প্রস্তাব করা হয়নি এবং সে কারণে বিদেশি কোনো কোম্পানি বাংলাদেশে জ্বালানি অনুসন্ধানে এগিয়ে আসছে না। জানা যায়,  বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করার জন্য এখন অংশীদারিত্বের চুক্তির প্রস্তাবও সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে প্রায় দুই যুগেও বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করা যায়নি। দেশের সমুদ্রসীমায় ২৬টি তেল-গ্যাস ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে অগভীর অংশে ১১টি ও গভীর সাগরে ১৫টি। সীমানাবিরোধ নিষ্পত্তির পর ভারত ও মিয়ানমার দ্রুতগতিতে বঙ্গোপসাগরে তাদের অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। এক্ষেত্রে পিছিয়ে বাংলাদেশ। কারণ সাগরের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সক্ষমতাই নেই বাংলাদেশের। আবার বিদেশি কোম্পানিগুলোর সহযোগিতা নেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানাবিধ জটিলতা। ফলে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস থাকলেও তা ভোগ করতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু সরকার তার সাড়ে তিন বছর সময়ে ৯টি কূপ খনন করেছিলেন। এর মধ্যে অফসোরে (সাগরে) সাতটি, মূল ভূখণ্ডে ছিল দুটি। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র (তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাশটিলা) নামমাত্র মূল্যে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে ওই পাঁচ গ্যাস ফিল্ড থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত ১০ দশমিক ১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এসব ফিল্ডে আরও ৫ দশমিক ৪৬ টিসিএফ গ্যাস মজুদ আছে বলে ধারণা করা হয়। যার বাজারমূল্য ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু সরকারের পরের ৩৬ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে মাত্র ১২টি। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত মাত্র দুটি কূপ খনন করেছিল বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বঙ্গবন্ধু সরকারের পরেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার গ্যাস খাতের উন্নয়নে কাজ করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৪১টি কূপের মধ্যে বর্তমান সরকারের ১৩ বছরে ১৯টি কূপ খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পর মাত্র ৪১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সীমানায় ১১১ বছরে (প্রথম কূপ খনন ১৯১০ সালে) ৯৬টি কূপ খননের মাধ্যমে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে মোবারকপুর ও কসবার মতো কয়েকটি ফিল্ড। যেগুলোতে গ্যাসের আধার পেলেও বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করা হয়নি।

 

সর্বশেষ খবর