বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

১০ বছরেও শেষ হয়নি বিআরটি প্রকল্প

♦ গার্ডারের চাপায় ঘটছে হতাহত ♦ খানাখন্দ যানজটে অতিষ্ঠ মানুষ ♦ তিনবার বেড়েছে মেয়াদ ♦ আগামী মার্চে শেষের সম্ভাবনা ♦ দ্বিগুণ হয়েছে প্রকল্প ব্যয়

জয়শ্রী ভাদুড়ী

১০ বছরেও শেষ হয়নি বিআরটি প্রকল্প

পাশেই চলছে গাড়ি, অন্যদিকে বিআরটি প্রকল্পের কাজ। গতকাল তোলা ছবি -রোহেত রাজীব

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন দেশের প্রথম বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প শেষ হয়নি ১০ বছরেও। তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ হয়েছে মাত্র ৮০ শতাংশ। কাজের ধীরগতির কারণে ভাঙাচোরা-খানাখন্দে ভরা রাস্তায় বছরের পর বছর অসহনীয় যানজটে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ। দফায় দফায় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিআরটি প্রকল্প এলাকা।

সোমবার রাজধানীর উত্তরায় প্রাইভেট কারের ওপর বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার পড়ে মারা গেছেন পাঁচজন। প্রকল্পে দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষ এবং ঠিকাদারের গাফিলতিকে দায়ী করছেন নিহতদের স্বজনরা। কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই এ রকম ব্যস্ত সড়কে চলছে নির্মাণ কাজ। গত মাসেও গার্ডার চাপায় এ প্রকল্পের এক নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছেন। গত বছর প্রকল্পের দুই জায়গার দুর্ঘটনায় ছয়জন আহত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে খুঁড়িয়ে চলা এ প্রকল্পের কারণে রোদবৃষ্টি মাথায় করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হয় উত্তরা-আবদুল্লাহপুর-গাজীপুরগামী যাত্রীদের। শুষ্ক মৌসুমে ধুলায় ঢেকে যায় পুরো এলাকা।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে যানজট নিরসনের জন্য ২০১২ সালে সরকার দেশের প্রথম বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প (বিআরটি) হাতে নেয়, যা ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড এ প্রকল্পের কাজ করছে। ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট রুট (বিআরটি) নির্মাণ কাজ চলতে থাকায় ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়ক এখন অসংখ্য খানাখন্দে ভর্তি। মাঝরাতেও যানজটে আটকে থাকতে হয় যাত্রীদের। খানাখন্দে ভরা এ সড়কে নিরাপদে যাত্রী পরিবহন করাই পরিবহন চালকদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই অংশে ভাগ করে কাজ চলছে প্রকল্পের। এক অংশে তিন দফা এবং আরেক অংশে দুই দফা বেড়েছে প্রকল্পের মেয়াদ। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। মেয়াদ বাড়ায় প্রকল্পের ব্যয় এখন দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংকটের কারণে খুঁড়িয়ে চলছে প্রকল্পের কাজ।

সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিমানবন্দরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এখানেই শুরু হয়েছে দুর্ভোগের সড়কপথ। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। এক পাশে বালুর ঢিবি, অন্যপাশে মাটি খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে এঁকেবেঁকে চলছে গাড়ি। উত্তরা রাজলক্ষ্মী পার হয়ে কিছু জায়গায় প্রকল্পের কাজ চলছে। আজমপুর থেকে আবদুল্লাহপুর ব্রিজ পর্যন্ত উড়ালসড়কের স্লাব বসানোর কাজ প্রায় শেষ। মাঝেমধ্যে দু-একটি স্লাব ফাঁকা আছে। এখন মূল কাজ চলছে আবদুল্লাহপুর ব্রিজে। চারজন শ্রমিককে দেখা যায় রড ঝালাইয়ের কাজ করতে। দুই পাশ দিয়ে সরু বিকল্প পথে চলছে গাড়ি। বিভিন্ন জায়গায় খুঁড়ে পিলারের জন্য রড বসানো হচ্ছে। মাটির ঢিবি, বালুর স্তূপে দখল সড়কের জায়গা। এর সঙ্গে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, রডসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে সড়কের মাঝে। দিনের অধিকাংশ সময় যানজট লেগে থাকে গুরুত্বপূর্ণ এ পয়েন্টে।

চারদিকে গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। চৌরাস্তার সরু জায়গায় গাড়ির চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। তীব্র রোদে, গরমে যানজটে যাত্রীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর সঙ্গে ধুলা আর গাড়ির হর্নে অসহনীয় অবস্থা। বছরের পর বছর ধরে এ প্রকল্পের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এ পথে চলাচলকারী ২১ জেলার যাত্রীদের। মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য হাসান আলী বলেন, ‘আবদুল্লাহপুর মোড়ে সারা বছরই যানজট লেগে থাকে। প্রকল্পের কাজ চলার কারণে রাস্তার অনেক অংশ বন্ধ রয়েছে। সরু রাস্তায় গভীর রাতেও গাড়ির তীব্র চাপ থাকে।’

বিআরটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ জুলাই পর্যন্ত ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যে মূল কাজ এবং আগামী বছর মার্চের মধ্যে সার্বিক কাজ শেষ হওয়ার আশা রয়েছে। বিকল্প সড়কে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রেখে ২৪ ঘণ্টায় কয়েক শিফটে কাজ চলছে। ঠিকাদারদের আর্থিক সংকটে প্রকল্পের কাজে ধীরগতি ছিল। এখন কিছুটা সমাধান হলেও সংকট আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০১২ সালে প্রকল্প নেওয়া হলেও কাজ শুরু হয়েছে ২০১৮ সালে। প্রকল্পের দুই অংশে কাজ চলছে। এক অংশে তিনবার এবং আরেক অংশে দুবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের। এর মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ২১ জেলার মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। এ এলাকাজুড়ে অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। পণ্য পরিবহন সহজ হওয়ায় শিল্প খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ সড়কপথ।’

আমাদের টঙ্গী প্রতিনিধি আফজাল জানান, টঙ্গী কলেজ গেট ও গাজীপুর শিল্প এলাকার ব্যস্ততম সড়কে চলছে বিআরটি প্রকল্পের কাজ। নির্মাণাধীন উড়ালসড়ক ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে নেই কোনো ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা। সারা দিন বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী ওঠানামা করছে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা না রেখেই নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ ব্যাপারে বিআরটি প্রকল্পের প্রকৌশলী মো. তৌহিদুজ্জামান বলেন, ‘মূল সড়কের ওপর শতভাগ নিরাপত্তা দেওয়া কঠিন। তবে আমরা যখন “আই গার্ডার” বসাই তখন চার-পাঁচ জন ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন। যে জায়গা দিয়ে গার্ডার বসানো হয়, সেখানে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখি।’

আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধি খায়রুল ইসলাম জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশে চলছে বিআরটি প্রকল্পের কাজ। এ অংশের নির্মাণ কাজের ধীরগতির কারণে তীব্র দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রী ও চালকদের। সরেজমিন দেখা যায়, সড়কের কিছু স্থানে উড়ালসড়কের স্প্যান, গার্ডার বসানোর কাজ চলছে। সড়ক মেরামত, বিআরটি স্টেশন স্থাপন, ড্রেন পরিষ্কার ও মেরামতের কাজ চলছে। মহাসড়কের মধ্যে কিংবা এক পাশে নির্মাণসামগ্রী রেখে কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্পের বিভিন্ন স্থানে ২৫টি স্টেশন হবে। সড়কের টঙ্গী হোসেন মার্কেট, গাছা, বোর্ডবাজার, মালেকের বাড়ী, ছয়দানা, বড়বাড়ী, ভোগড়াসহ বেশকিছু স্থানে রাস্তার মাঝখানে ১৮টি স্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে। স্টেশন তৈরির কাজ চলমান থাকায় সেখানে যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না।

চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিভিন্ন স্থানে নির্মাণসামগ্রী রেখে প্রকল্পের কাজ চলছে। চৌরাস্তার মোড়ের দুই দিকে থেমে থেমে চলছে যানবাহন। সামান্য বৃষ্টি হলেই মহাসড়কে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। প্রভাতি-বনশ্রী পরিবহনের চালকের সহকারী কাইয়ুম বলেন, ‘সামান্য বৃষ্টিতেই গাড়ি চালাতে কষ্ট হয়। বৃষ্টি হলেই মহাসড়কের অনেক স্থানের গর্ত ও খানাখন্দে পানি জমে। এতে মহাসড়কে যান চলাচলের গতি ধীর হয়ে পড়ে। তখন যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে।’

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের গাজীপুর মহানগর সাধারণ সম্পাদক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্পের ধীরগতি এবং দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রকল্পটির কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে।’ জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুকুল কুমার মল্লিক বলেন, ‘ধীরগতির কারণে গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলার যাত্রীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এ দুর্ভোগ লাঘবে দ্রুত প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার জোর দাবি জানাচ্ছি।’ গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘ট্রাফিক বিভাগ যতটুকু জনবল আছে তাই দিয়ে যানজট নিরসনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ১৪ জুলাই থেকে জিএমপির ট্রাফিক, ক্রাইম ও ডিবি যৌথভাবে রাস্তায় কাজ করছে। দুর্ঘটনা রোধে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর