বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

হোটেল মালিক গ্রেফতার ভবন মালিক পলাতক

চকবাজারে আগুনে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন অপেক্ষায় স্বজনরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুরান ঢাকার চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনে সোমবারের অগ্নিকাণ্ডের পর উদ্ধার হওয়া ছয় মৃতদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তবে লাশের জন্য অপেক্ষা শেষ হয়নি স্বজনদের। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগের সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় গতকালও কোনো লাশ হস্তান্তর করা হয়নি। এদিকে হোটেল মালিক ফখরউদ্দিনকে কেরানীগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে ভবন মালিক রানা এখনো পলাতক।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. ওমর ফারুক জানান, লাশগুলো থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো সিআইডির ফরেনসিক টিমকে দেওয়া হবে।

পুলিশ বলছে, মৃতদেহ দেখে চেনার উপায় নেই। যদি স্বজনরা এ অবস্থায় লাশ শনাক্ত করে লিখিত দেন তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তা হস্তান্তর করা হবে। নয় তো ডিএনএ পরীক্ষার পর হস্তান্তর করা হবে।

অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্বজনদের সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা যায়। নিহত হোটেলকর্মী স্বপন সরকারের বড় ভাই সজল সরকার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন শুধু ভাইয়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাই।’

তাঁর মতো নিহত অন্য পাঁচজনের পরিবারের সদস্যরাও লাশ নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। একটু পরপরই প্রিয়জনের স্মৃতিচারণা করে আহাজারি করছিলেন তাঁরা।

দেবীদাস ঘাট লেনে বরিশাল হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সেখানকার মাচায় ঘুমিয়ে থাকা ছয় কর্মচারীর পোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় গতকাল চকবাজার থানায় হোটেল মালিক ফখরউদ্দিন ও ভবন মালিক মো. রানাকে আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। মামলায় আরও কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামি দেখানো হয়েছে। আগুনে নিহত রুবেলের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এর আগে গতকাল ভোরে ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা থেকে হোটেল মালিক ফখরউদ্দিনকে গ্রেফতার করে চকবাজার থানা পুলিশ। তবে ভবন মালিক রানা ঘটনার পর থেকে পলাতক। পরে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে ফখরউদ্দিনকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত এক দিন মঞ্জুর করেছেন। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাইয়ুম বলেন, হোটেল মালিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বরিশাল হোটেলের কর্মচারী রুবেলের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী হোটেল মালিক ফখরউদ্দিনের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ করেছেন। রবিবার রাতে কাজ করে সেখানে ঘুমিয়ে ছিলেন বরিশালের মুলাদীর বিল্লাল সরদার (৩৫), হবিগঞ্জের লাখাইয়ের স্বপন সরকার (১৮), শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের ওসমান দেওয়ান (২৫), মাদারীপুরের কালকিনির রুবেল (২৭), বরিশালের হিজলার মোতালেব (১৬) ও কুমিল্লার চান্দিনার শরিফ (১৬)। এরা সবাই আগুনে পুড়ে মারা যান।

গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন বলেন, যে-কোনো অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে দেখা হয় কার গাফিলতি ছিল বা কী কারণে আগুন লেগেছে। কারও গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ঘটনায় যারা জড়িতদের আইনের আওতায় আনার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আর সিআইডির ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ে লাশ শনাক্তের পর তা স্বজনদের হস্তান্তর করা হবে।

যেভাবে বিস্ফোরণ : অন্যদিনের চেয়ে দিনটার শুরু ছিল ভিন্নরূপে। জাতীয় শোক দিবসে সরকারি ছুটি থাকায় দোকানপাট ও কারখানা ছিল বন্ধ। ছিল না কোনো কোলাহল। মানুষের ছোটাছুটি আর নিত্যদিনের যানজটও ছিল না। বলছি পুরান ঢাকার চকবাজারের কামালবাগের কথা। যদিও দেবীদাস লেন ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় আর চকবাজারে মালটানা মানুষে লোকারণ্য নিত্যদিনের চিত্র। এ লেনেই বরিশাল হোটেল। ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে হোটেলটি। আশপাশে নানা ধরনের কারখানা আর গুদামে আসা মানুষের একমাত্র খাবারের হোটেল।

ওই লেন ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর ঘাটের দিকে মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। তখন সোমবার বেলা প্রায় ১১টা। মুহূর্তেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। হোটেলটি পার হওয়ার আগেই মোটরসাইকেলের ব্রেকে পা রাখেন তিনি। ঘড়ির কাঁটা সেকেন্ডের ঘরে গড়াতে না গড়াতেই দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু হয়। এ সময় হোটেলের ভিতর থেকে দুজন কাস্টমার, বাবুর্চি আর দুজন কর্মচারী বেরিয়ে আসেন। এসব ভাষ্য, সেই মোটরসাইকেল চালক প্রত্যক্ষদর্শীর।

বিস্ফোরণের পর আগুন দাউদাউ করে চার তলা ভবনের এক পাশে জ্বলে ওঠে। পেছনের দিকের ছাদ ফেটে আগুন চলে যায় চার তলায় প্লাস্টিকের গুদামে। প্রাথমিকভাবে ঘটনাস্থলের চিত্র দেখে অবৈধ গ্যাস লাইন থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে ধারণা করছেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

ভবনটি ছিল অবৈধ : আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে ভবনে আগুন লাগে সেটি সরকারি জায়গায় গড়ে তোলা। স্থানীয় যুবলীগ নেতা মো. রানা জায়গাটি লিজ নিয়ে চার তলা ভবন গড়েছেন। যদিও এ ভবনের অনুমোদন নেই। ভবনটির তিন তলা পর্যন্ত লোহার বার দিয়ে বানানো। চার তলা করা হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল টিনশেড দিয়ে। হোটেলটি ছাড়া পুরোটাই প্লাস্টিক পণ্য গুদামজাতে ভাড়া দেওয়া। ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এ ভবনের চারপাশে প্লাস্টিক খেলনা সামগ্রী, ঘরের ব্যবহার্য পণ্যসহ নানা পণ্যের একাধিক কারখানা এবং গুদাম। ভবনের পেছনে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ও মেমোরি কার্ড বানানোর একটি গোপন কারখানাও দেখা গেছে। আগুনের সূত্র খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, বরিশাল হোটেলের প্রবেশমুখেই ডান পাশে রান্নার চুলা। পাইপলাইনের গ্যাসের মাধ্যমে এ হোটেলের রান্নার কাজ চলত তা বোঝা গেল। চুলার চেম্বারের পাশেই হোটেলের দেয়ালঘেঁষে গ্যাসের রাইজার ও গ্যাসলাইন। ওই গ্যাসলাইনের একটি আবার চলে গেছে হোটেলের চুলার চেম্বারে। সেখান থেকে আবার খুবই ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্লাস্টিক পাইপের মাধ্যমে হোটেলের আরেকটি চুলায় গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনার পর ওই চুলার বার্নারটি খুলে রাস্তায় পড়ে ছিল। এ বার্নারের গোড়াতেই প্লাস্টিক পাইপ ঝুলতে দেখা যায়। হোটেলটির ঠিক ওপরেই কাঠের পাটাতন দিয়ে কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। হোটেলের পেছনে আলাদা সিঁড়ি ব্যবহার করে কর্মীরা ওই ঘরে যাতায়াত করতেন। দুই শিফটে কাজ করে পালাক্রমে কর্মীরা সেখানেই ঘুমাতেন।

সর্বশেষ খবর