শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

কী ঘটেছে শিক্ষক দম্পতির

সড়কের পাশে প্রাইভেট কারে মিলেছে লাশ, পরিবারের দাবি হত্যা

গাজীপুর ও টঙ্গী প্রতিনিধি

কী ঘটেছে শিক্ষক দম্পতির

জিয়াউর রহমান মামুন ও তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার জলি

গাজীপুরে শিক্ষক দম্পতির লাশ তাদের প্রাইভেট কার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল ভোরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের গাছা থানার বড়বাড়ির বগারটেক এলাকার সড়কের পাশে থাকা ওই গাড়ি থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরিবারের দাবি তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

নিহতরা হলেন- গাজীপুর সিটি করপোরেশনের গাছা থানার কামারজুরি এলাকার মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে এ কে এম জিয়াউর রহমান মামুন (৫১) ও তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার জলি (৩৫)। জিয়াউর রহমান টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং তার স্ত্রী জলি টঙ্গী বাজার এলাকার আমজাদ আলী সরকার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা পদে কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনায় শিক্ষক ও নিহতের পরিবারের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।

জিয়াউর রহমানের ভগ্নিপতি মাওলানা আবদুর রশিদ জানান, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের গাছা থানার কামারজুরি এলাকার নিজ বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করতেন জিয়াউর রহমান। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দড়িকাঁঠাল এলাকায়। জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী জলি টঙ্গীর পৃথক স্কুলে চাকরি করলেও তারা প্রতিদিন একসঙ্গে নিজস্ব প্রাইভেট কারে স্কুলে যাওয়া-আসা করতেন। বুধবার স্কুল শেষে বিকাল সাড়ে ৬টার দিকে মামাতো ভাইকে গাড়িতে তুলে জিয়াউর নিজে গাড়ি চালিয়ে স্ত্রী জলির স্কুলে যান। সেখান থেকে জলিকে গাড়িতে তুলে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন তিনি। পথে মামাতো ভাইকে রাস্তায় নামিয়ে দেন তারা। জিয়াউর রহমানের ছেলে এ ক এম তৌসিফুর রহমান মিরাজ সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে বাবার মোবাইলে ফোন দেন। কিন্তু বাবার ফোন রিসিভ না হওয়ায় তার মায়ের ফোনে ফোন দিচ্ছিলেন। পরে মা ফোন ধরে বাসায় আসার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমরা পথে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় আসছি’।

তৌসিফুর রহমান মিরাজ জানান, মোবাইলে কথা বলার সময় মায়ের কথাবার্তায় ক্লান্তির ভাব বুঝতে পারি। এর দীর্ঘক্ষণ পরও বাসায় না আসায় আমি আবার ফোন করি। কিন্তু রিং বাজলেও মা-বাবা কেউ ফোন রিসিভ করেননি। এরপর একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তাদের হদিস না পেয়ে স্বজনরা রাতভর বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। তারা গাছা থানা, টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা এবং পুবাইল থানায়ও যোগাযোগ করেন। বড় চাচা ও ফুপাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা পুবাইল থানায় খোঁজ করে গতকাল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ফিরছিলাম। পথে বাড়ির কাছে গাছা থানার বড়বাড়ির বগারটেক এলাকায় হারবাইদ-বড়বাড়ি সড়কের পাশে জিয়াউর রহমানের প্রাইভেট কারটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমরা গাড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে চালকের সিটে বাবা এবং তার পাশের সিটে (সামনে) মায়ের শীতল ও নিথর দেহ দেখতে পাই। আমরা তাদের উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় বোর্ডবাজারে তায়েরুন্নেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে উত্তরার নস্ট্রাম নামের অপর একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাদের মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। এরপর দুটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের লাশ গাছা থানায় আনা হয়।

নিহতের সহোদর মো. রিপন ও শ্যালিকা আহমিদা আক্তার লিমা বলেন, নিহতদের গলায় কালো দাগ রয়েছে। তাদের মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। এটি পরিকল্পিত হত্যা। তাদের সঙ্গে থাকা স্বর্ণালঙ্কার, নগদ প্রায় ২ লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন কিছুই নেয়নি হত্যাকারীরা। ঘটনাটি যদি পরিকল্পিত না-ই হতো তাহলে টাকা, স্বর্ণ, মোবাইল ও গাড়ি নিয়ে যেত। অথচ তার কিছুই তারা নেয়নি। শুধু দুজনের জীবন নিয়ে গেছে। এলাকায় বা পরিবারের মাঝে কোনো বিরোধ নেই। তবে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সম্প্রতি তার স্কুলের কয়েকজনের সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে বলে জেনেছি। প্রায় দুই বছর আগে টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন জিয়াউর রহমান। এর আগে তিনি দীর্ঘদিন টঙ্গীর নোয়াগাঁও উচ্চবিদ্যালয়সহ নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের একাধিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ময়নাতদন্তের পর জানাজা শেষে লাশ দুটি জিয়াউর রহমানের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হবে।  ভগ্নিপতি মাওলানা আবদুর রশিদ আরও জানান, প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রায় ছয়-সাত বছর আগে মাহমুদা আক্তার জলিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন জিয়াউর রহমান। দ্বিতীয় সংসারে তাদের কোনো সন্তান নেই। তবে প্রথম সংসারের একমাত্র সন্তান তৌসিফুর রহমান মিরাজ গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছেই থাকে। পরিবারের কারও সঙ্গে এ দম্পতির কোনো বিরোধ নেই।  গাছা থানার পরিদর্শক নন্দলাল চৌধুরী বলেন, এই দম্পতি কীভাবে মারা গেলেন বা কেউ মেরে ফেলেছে কি না- এই মুহূর্তে কিছুই বলা যাচ্ছে না। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপ-কমিশনার (অপরাধ) মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ বলেন, ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করা হয়েছে। এটি পরিকল্পিত হত্যা কি না- তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ দুটি গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।  শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কে এম জিয়াউর রহমানের লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে বিদ্যালয়ে ছুটে আসেন তাঁর সহকর্মী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তারা শিক্ষক হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন। টঙ্গী শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি বি.কম মতি বলেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়াউর রহমান মামুন প্রতিদিনের মতো গত বুধবারও স্কুলের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন; কিন্তু কারা যে তাদের মেরে ফেলল- আল্লাহ ভালো জানেন। মামুন একজন ভালো মানুষ এবং ভালো শিক্ষক ছিলেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর