শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
সাগরে নিম্নচাপ

১১ জেলে নিখোঁজ, নিঝুমদ্বীপে নিহত ২, বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে

সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত

নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি নিম্নচাপে রূপ নিয়েছে। ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকায় গতকাল  সমুদ্রবন্দরগুলোতে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়। আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাসে বলা হয়, নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলীয় দ্বীপ ও চরাঞ্চলের নিচু এলাকা স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে দুই থেকে চার ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন জানান, উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে গতকাল সকালে উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় নিম্নচাপে রূপ নেয়। এটি আরও ঘনীভূত হতে পারে এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। নিম্নচাপের প্রভাবে গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালার সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে এবং দেশের উপকূলীয় এলাকায় বায়ুচাপের পার্থক্যের আধিক্য বিরাজ করছে। ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। এ সময় নিম্নচাপ ও বায়ুচাপের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনাম বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের দ্বীপ ও চরাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে চার ফুট পর্যন্ত বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী আজ ও আগামী দুই দিন দেশজুড়ে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা থাকতে পারে। এদিকে আমাদের  প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূলের নাজিরারটেক চ্যানেলে গতকাল একটি ফিশিং ট্রলার ডুবে ট্রলারে থাকা ১৮ জেলের মধ্যে সাতজনকে উদ্ধার করা গেলেও ১১ জন নিখোঁজ রয়েছেন। উত্তাল সাগরে প্রচণ্ড ঢেউয়ে ‘মায়ের দোয়া ফিশিং ট্রলার’টি ডুবে যায়। এ ছাড়া নোয়াখালীর উপকূলীয় হাতিয়া উপজেলার নিঝুম দ্বীপের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা ট্রলার উল্টে দুজন নিহত এবং এক জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। তাকে উদ্ধারে অভিযান চালানো হচ্ছে। ট্রলারে মোট জেলেসহ ১৬ জন ছিলেন, এর মধ্যে ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে এবং একজন নিখোঁজ হন।

এ বিষয়ে জাহাজমারা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি রাশেদ ও স্থানীয় বাসিন্দা জিল্লুর রহমান জানান, ১৬ জন জেলে নিয়ে কয়েকদিন আগে মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে যায় এমবি সিরাজ নামের একটি ট্রলার। বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত মাছ ধরা শেষ করে গতকাল ভোরে ঘাটের উদ্দেশে যাত্রা করেন জেলেরা। সকাল ১০টার দিকে তাদের ট্রলারটি নিঝুমদ্বীপ এলাকার বঙ্গোপসাগরের ধমারচরে পৌঁছালে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। এতে ট্রলারে থাকা ১৬ জেলে সাগরে পড়ে যান। পরে পাশে থাকা ‘এমবি ইয়ামিন চৌধুরীর’ ট্রলার ১৩ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করে। ডুবে যাওয়া ট্রলারটি পাশের একটি চরে গিয়ে আটকা পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত ট্রলারের ভিতর থেকে মাইন উদ্দিন ও রাফুলের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

এদিকে উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে গতকাল খুলনার উপকূলীয় কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপে ঝড়ো বাতাস প্রবাহিত হয়। সেই সঙ্গে থেমে থেমে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। এ অবস্থায় জোয়ারের পানির চাপে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে নতুন করে ভাঙনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, দুপুরের পর থেকে বাতাসের গতি বাড়তে থাকে। এর মধ্যে কয়রার দক্ষিণ বেতকাশি চরামুখা পয়েন্টে ভেঙে যাওয়া রিংবাঁধ টানা পাঁচ দিনের স্বেচ্ছাশ্রমের পর ১৭ আগস্ট পানি আটকানো হলেও গতকাল বিকালে আবারও বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। স্থানীয় ইউপি সদস্য ওসমান গনি সরদার বলেন, ‘কয়েকদিনের চেষ্টার পর বেড়িবাঁধ আটকানো গেছে। তবে সিগন্যালে (আবহাওয়ার পূর্বাভাস) এখন বেকায়দা অবস্থা, ঝড়ো বাতাস হচ্ছে। কত দিন বাঁধ টিকে থাকে বলা যাচ্ছে না। বাতাসের গতির সঙ্গে জোয়ারের পানিও বাড়ছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে।’ সোলাদানা ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ মোল্লা জানান, বৈরী আবহাওয়ায় ৪ নম্বর ওয়ার্ডে গুচ্ছ গ্রামে ২০০ পরিবার ভোগান্তিতে রয়েছে। নদীর চরে থাকা ৭০টি পাকা ঘর, ৩০টি টিনের ঘর ও ১০০টি আঘাপাকা ঘরে জোয়ারের পানি ঢুকেছে। এ ছাড়া ঘর পায়নি এরকম ৫০টি পরিবারও সেখানে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বিপাকে পড়েছে।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে বরিশালসহ উপকূলীয় এলাকায় থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার চর ও দ্বীপসমূহে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২ থেকে ৪ ফুটের অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা করছে আবহাওয়া বিভাগ। নিম্নচাপের কারণে সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত এবং বরিশাল নদীবন্দরে জারি করা হয়েছে ২ নম্বর নৌ-হুঁশিয়ারি সংকেত। এ কারণে ৬৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যরে লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিআইডব্লিউটিএ। দুর্যোগ পরবর্তী তৎপরতার জন্য প্রস্তুত রয়েছে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিসি)। 

বরিশাল আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক আবদুল কুদ্দুস জানান, গতকাল সকাল থেকে থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৪.১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে স্থানীয় আবহাওয়া অফিস। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক শাহাবুদ্দিন মিয়া জানান, এ মুহূর্তে ৩ নম্বর সিগন্যাল চলছে। ৪ নম্বর সিগন্যাল হলে সিপিপি পতাকা উত্তোলন এবং মাইকিং করবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রয়েছে। যে কোনো দুর্যোগ হলে পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতার জন্যও সিপিপি প্রস্তুত রয়েছে। জানা গেছে, উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে টিকতে না পেরে সমুদ্রে ইলিশ আহরণে থাকা কয়েক হাজার ফিশিং ট্রলার সুন্দরবনের দুবলার চর, মেহের আলীর চর, ভেদাখালীর অফিস খাল, কটকা, কচিখালী, হিরণ পয়েন্ট, বাগেরহাটের প্রধান মৎস্যবন্দর কেবি ফিশারিঘাট, শরণখোলার রায়েন্দ, রাজেশ্বর, পূর্ব খোন্তাকাটা, রাজৈর, মোংলা, রামপাল, মোড়েলগঞ্জসহ উপকূলের বিভিন্ন মৎস্যবন্দরে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। নিম্নচাপের প্রভাবে গতকাল সকাল থেকে সুন্দরবনসহ বাগেরহাটের নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে বৃষ্টিসহ ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। দিনভর বৃষ্টিসহ ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওযায় মোংলাবন্দর ও আউটারবারে পণ্য ওঠানামার কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বন্দরের হারবার বিভাগ।

সমুদ্রগামী মৎস্য আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম হাওলাদার ও শরণখোলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে সাগরে আছড়ে পড়ছে বিশাল বিশাল ঢেউ। সাগরে জাল ফেলতে পারছেন না জেলেরা। উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে টিকতে না পেরে গভীর সমুদ্রে ইলিশ আহরণে থাকা হাজার হাজার ফিশিং ট্রলার বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। বঙ্গোপসাগর অশান্ত হয়ে ওঠায় বাগেরহাট জেলার প্রায় ১৩ হাজার জেলে ফিশিং ট্রলার বৃহস্পতিবার রাত থেকে সাগর ছেড়ে এখন সুন্দরবনসহ কূলে অবস্থান করছে। শরণখোলার শতাধিক ট্রলার সুন্দরবন ও উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় নিরপাদ আশ্রয় নিয়েছে। একইভাবে গতকাল বিকাল পর্যন্ত বাগেরহাটের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের কেবি ফিশারি ঘাটে শতাধিক ফিশিং ট্রলার ঘাটে নোঙর করে। মোংলা আবহাওয়া অফিস ইনচার্জ অমরেশ চন্দ্র ঢালী জানান, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ফের সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে সাগর উত্তাল হয়ে ওঠায় উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ফিশিং ট্রলারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত  নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে সাতক্ষীরা উপকূলের সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের দেওয়া  ৩ নম্বর সতর্ক সংকেতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন উপকূলবাসী। সকাল থেকে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে ঝড় হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। দিন ভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হলেও দুপুর থেকে ভারী বর্ষণ ও দমকা হাওয়া শুরু হয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া, চুনা, রায়মঙ্গলসহ উপকূলের সব নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ ও ২ এর আওয়ায় বেশ কিছু বেড়িবাঁধ। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, পদ্মপুকুর, মুন্সীগঞ্জ, ভেটখালী এবং আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নবাসী। বৃষ্টিপাতের কারণে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কপোতাক্ষ নদের কুড়িকাওনিয়া ও হরিষখালী বেড়িবাঁধে পানি ওভার ফ্লো হচ্ছে। ফলে তাৎক্ষণিক বাঁধ সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেলে ভাঙনের শঙ্কাও করছেন উপকূলবাসী। সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের উচ্চমান পর্যবেক্ষক জুলফিকার আলী রিপন জানান, বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের কারণে ৩ নম্বর সর্তক-সংকেত চলছে। উপকূল অঞ্চালে ঝড়ো হাওয়া বইবে। এ ছাড়া নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের  চেয়ে জোয়ারের পানি ২ থেকে ৪ ফুট জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে।

সাগরে ট্রলারডুবি সাত জেলে নিখোঁজ : কূলে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলার ডুবে গেছে। এ ঘটনায় কোস্টগার্ড আট এবং স্থানীয়রা চার জেলেকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। এখনো সাত জেলে নিখোঁজ। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে কক্সবাজারের নাজিরারটেক চ্যানেল থেকে জেলেদের উদ্ধার করা হয়। জেলেরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারটি সাগরে মাছ ধরতে যায়। ওই ট্রলারে ১৯ জন জেলে ছিলেন। পরে সাগরে বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করায় তাঁরা কূলে ফিরে আসছিলেন। এ সময় শহরের ডায়াবেটিস পয়েন্ট থেকে প্রায় ৪ নটিক্যাল মাইল দূরে ঢেউয়ের ধাকায় ট্রলারটি ডুবে যায়। পরে কোস্টগার্ড ও অন্য ট্রলারগুলো ১২ জেলেকে উদ্ধার করলেও বাকিরা এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

ওই ট্রলারটির মালিক কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়নের জাকির হোসেন। ট্রলারের সব জেলেই খুরুশকুলের বাসিন্দা।

সর্বশেষ খবর