শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

অপরাধে এক ব্যক্তি বারবার

ঢাকায় ৬০ শতাংশই পেশাদার অপরাধী, ফিঙ্গারপ্রিন্টের তথ্য বিশ্লেষণ

মাহবুব মমতাজী

অপরাধে এক ব্যক্তি বারবার

২০১৬ সালের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় একটি জুয়েলারি দোকানে চুরি হয়। ঘটনার এক মাস পর সদর উপজেলায় একই কায়দায় আরেকটি জুয়েলারি দোকানে চুরি হয়। পরে ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট।

মামলা তদন্তে সোনারগাঁ থানা পুলিশের কোনো অগ্রগতি না থাকায় দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি)। আসামি গ্রেফতার ও চুরির রহস্য উদ্ঘাটন না করেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় ডিবি। আর সদর থানার চুরির মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে।

এদিকে রাজধানীর গুলশান-২-এর ১০৭ নম্বর সড়কে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর একটি বাড়িতে চুরি হয়। এ ঘটনায় ওই দিনই গুলশান থানায় মামলা হয়। ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন ফরেনসিক আলামত সংগ্রহ করে রাখে সিআইডি। দীর্ঘ সময় তদন্ত করে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ।

সিআইডি সূত্র বলছেন, গত বছর ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় একটি বাসায় চুরির ঘটনায় মামলা হয়। এ মামলায় গ্রেফতার হন ফরহাদ নামে একজন। ২০১৫ সালে গুলশানে চুরির পর ঘটনাস্থলের আলামতের ফরেনসিক ও বিভিন্ন কাপড় এবং জিনিসপত্রের ওপর থাকা আঙুলের ছাপ স্ক্যানিং ও কোডিং করে দেখা গেছে, তা ফরহাদের আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে গেছে। অর্থাৎ প্রায় ছয় বছর আগের চুরির ঘটনায়ও জড়িত ছিলেন ফরহাদ। এ ছাড়া ২০১৯ সালে কদমতলী থানার একটি মামলায় গ্রেফতার হন ইউনুছ আলী নামে এক ব্যক্তি। পরে নারায়ণগঞ্জ সদরের চুরি হওয়া ঘটনাস্থলের আলামতের ফরেনসিক কোডিং করেও দেখা গেছে ইউনুছের আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে যায়। পরে তাকে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার চুরির মামলায়ও শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়েছে সিআইডি। এরপর নারায়ণগঞ্জ ও রাজধানীর বিভিন্ন থানার একাধিক চুরির মামলায় নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন ইউনুছ। এসব তথ্য মিলেছে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের অফিস ডাটা ব্যাংকে। এখানে তথ্য বিশ্লেষণ করে সিআইডি কর্মকর্তারা দেখেছেন, একই ব্যক্তিই বারবার চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িত হচ্ছেন। ফরেনসিকের অফিস ল্যাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৪ আগস্ট পর্যন্ত তাদের ডাটা ব্যাংকে ২ লাখ ৪৩ হাজার ফিঙ্গারপ্রিন্টের তথ্য জমা হয়েছে। এসবের মধ্যে ঢাকায় যেসব ব্যক্তির ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের ৬০ শতাংশই এক অপরাধে বারবার জড়িয়ে পড়েন। অর্থাৎ চুরি, মাদক কিংবা ছিনতাইয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান, জামিনে বেরিয়ে আবার অপরাধ করেন। এদের বিরুদ্ধে করা প্রায় ৭০ শতাংশই মাদকের মামলা। যদিও এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ল্যাব-সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা। তবে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান এ প্রতিবেদককে জানান, হাজারো মামলার তদন্ত ও পরবর্তী সময়ে বিচারিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে ভূমিকা রাখছে সিআইডির ফরেনসিকের অফিস ডাটা ব্যাংক। অনেক ক্লুলেস ঘটনারও ক্লুও বের হচ্ছে এ ল্যাবের তথ্য বিশ্লেষণ থেকে। অপরাধীদের শনাক্তে এ ডাটাবেস ব্যবহার করছে অন্যান্য সংস্থাও। জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টে ছিনতাই করে পালানোর সময় এক ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরেন ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্য মোহাম্মদ পারভেজ। তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান এই দুর্বৃত্ত। আহত পারভেজ ওই দিনই হাসপাতালে মারা যান। ওই হত্যার ঘটনায় করা মামলায় পাঁচ বছর কারাগারে ছিলেন আবু তাহের। চলতি বছর মে মাসে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এর তিন মাস না পেরোতেই ১৬ আগস্ট আরেকটি হত্যার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। পুলিশ বলছে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে অপরাধে জড়ানো আবু তাহেরের মতো কিশোর বয়সেই অপরাধীর খাতায় নাম লেখান ঢাকার সবুজবাগের রুবেল চৌকিদার। বয়স ২৫ না পেরোতেই তার ঘাড়ে এখন ১২ মামলা। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মাদক ও চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগে করা এসব মামলায় একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। জামিনে বেরিয়ে তিনিও অপরাধের পথে হেঁটেছেন। সিআইডির তথ্যানুযায়ী, ফরহাদ, ইউনুছ, আবু তাহের ও রুবেল চৌকিদারের মতো সারা দেশে এ রকম অপরাধীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। ফিঙ্গারপ্রিন্টের তথ্যানুযায়ী ঘুরেফিরে এরাই বারবার নানা ধরনের অপরাধ করার পর গ্রেফতার হচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবু তাহেরের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় মামলা আছে ১০টি। এর মধ্যে তিনটি হত্যা, একটি অস্ত্র, তিনটি মাদক ও তিনটি চুরির মামলা। গত বছর ২৪ আগস্ট ঢাকার সাভারে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে সিআইডি। ১৭ সেপ্টেম্বর রপ্তানির পোশাক চোর চক্রের হোতা সাঈদ ওরফে সিলেটি সাঈদকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ২৪টি চুরির মামলা আছে। একটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে আট মাস কারাগারে ছিলেন তিনি। সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ সূত্র বলছেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রথাগত পদ্ধতিতে (ম্যানুয়াল) আঙুলের ছাপের তথ্য সংরক্ষণ করা হতো। পরে অটোমেটিক ফিঙ্গার আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম সফটওয়্যারের মাধ্যমে আসামিদের আঙুলের ছাপের সংরক্ষণ শুরু হয়। ১০ হাজারের বেশি আসামির আঙুলের ছাপ ডাটা ব্যাংকে থাকা ছাপের সঙ্গে একাধিকবার করে মিলেছে। এ মিলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তারা বারবার গ্রেফতার হচ্ছেন। সিআইডি কর্মকর্তাদের ভাষ্য, দেশের যে-কোনো থানায় আসামি গ্রেফতার হলে তার আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে পুলিশ। এ ছাড়া সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে। আর আসামির নাম-ঠিকানাসহ মামলার বিস্তারিত সংরক্ষণ করা হয় পুলিশের সিডিএমএস (ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) সফটওয়্যারে। এ ছাড়া অপরাধের শিকার ব্যক্তির শরীর ও ঘটনাস্থলের বিভিন্ন জিনিসপত্রেও অপরাধীর আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়। সে ছাপও ফরেনসিক ডাটা ব্যাংকে থাকা তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে অপরাধী শনাক্ত করা হয়। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘পুলিশের কাজই হলো অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণ। আর যারা চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িত তারা মূলত ভাসমান থাকে। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গিয়ে অপরাধ করে। এ ছাড়া আমাদের আইনি প্রক্রিয়ায় কিছু ত্রুটি আছে। মামলার পর আসামির চেয়ে বাদীকে যন্ত্রণা পোহাতে হয় বেশি। বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় বছরের পর বছর লেগে যায়। এতে আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করা কঠিন হয়ে পড়ে। এসব পরিবর্তনে তদন্তের সঙ্গে তদারক ভালো হতে হবে। আর এসব পরিবর্তন হতে সময় লাগবে। অনেক কিছুর উন্নতি হয়েছে। এভাবে একটা সময় অপরাধীদের বারবার একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আর সুযোগ থাকবে না।’

 

সর্বশেষ খবর