রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

কূটনীতিকরা কেন রোষানলে

অনিয়ম অব্যবস্থাপনা দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ দূতাবাস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে

জুলকার নাইন

কূটনীতিকরা কেন রোষানলে

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে মিশিগানে কনস্যুলার সেবা দিতে গিয়েছিলেন এক দূতাবাস কর্মকর্তা। চার দিনের সেবা ক্যাম্প চালানোর কথা ছিল। দুই দিন ক্যাম্প চালানোর পর তৃতীয় দিন এসে স্থানীয় একটি নদীর পাড়ে কয়েকজন প্রবাসীর কাছে মারধরের শিকার হন ওয়াশিংটন দূতাবাসের প্রথম সচিব (পাসপোর্ট অ্যান্ড ভিসা)। বন্ধ হয়ে যায় কনস্যুলার সেবা। চলতি সপ্তাহের এ ঘটনাই শুধু নয়, গত সপ্তাহে ইউরোপের শ্রমঘন দেশ ইতালিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আক্রমণের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস। এর আগে গত মাসে কানাডায় বাংলাদেশের এক হাইকমিশনারকে প্রকাশ্যে হেনস্তা করেন হাইকমিশনেরই এক সাবেক বাংলাদেশি কর্মচারী। এভাবে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা দূতাবাসগুলোয় কর্মরত কূটনীতিকদের প্রায়ই পড়তে হচ্ছে রোষানলে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দূতাবাসগুলো মূলত পাসপোর্টসহ কনস্যুলার সার্ভিসের ক্ষেত্রে ভোগান্তির অভিযোগে অভিযুক্ত। এ ছাড়া দূতাবাসের বিভিন্ন নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার বাড়িয়ে তোলে ক্ষোভ। টাকা নিয়ে কাজ করার অভিযোগও থাকে এদের বিরুদ্ধে। শ্রমিক বেশি থাকা দেশগুলোয় দালাল তোষণের অভিযোগও আছে। দূতাবাসে ন্যূনতম বসার জায়গাও থাকে না সেবাপ্রার্থীদের। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোয়ও দূতাবাস কর্মীদের বিরুদ্ধে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। প্রবাসীরা এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বেশির ভাগ সময়ই দেখা পাওয়া যায় না দূতাবাসের শীর্ষ কূটনীতিকদের। কিন্তু সোসাইটির চিহ্নিত দলীয় পরিচয়ধারী কিছু ব্যক্তির সঙ্গে ঠিকই ঘনিষ্ঠতা দেখা যায় এসব কূটনীতিকের। মূলত এসব কারণেই দেশের দূতাবাসের ওপর তৈরি হয় রোষানল। জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় ১৯ আগস্ট মিশিগানে ভ্রাম্যমাণ কনস্যুলেট সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। এ সেবার আয়োজক হিসেবে নেওয়া হয় মিশিগান আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপকে। প্রথম দিনের কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে শেষ হলেও দ্বিতীয় দিন শনিবার সেবাপ্রত্যাশীদের চাপের সঙ্গে বিশৃঙ্খলা ও অব্যস্থাপনা দেখা দিতে শুরু করে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় শত শত সেবাপ্রত্যাশীকে। এ সময় স্বেচ্ছাসেবীদের বিরুদ্ধে লাইনের বাইরে থাকাদের নিয়মবহির্ভূত সেবা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পক্ষপাতিত্ব এবং আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও ওঠে। পরদিন ২১ আগস্ট রাতে স্থানীয় ডেট্রয়েট ডাউনটাউন নদীর পাড়ে ঘুরতে যান প্রথম সচিব মিল্টনসহ দূতাবাস কর্মকর্তারা। সেখানে সাত-আট জনের বাংলাদেশি দলটি হাজির হয়ে অব্যবস্থাপনা ও মিশিগানে স্থায়ী কনস্যুলেটের দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করেন। নদীর পাড়ে স্মারকলিপি নিতে অপারগতা জানিয়ে দূতাবাসের অফিশিয়াল ইমেইলে পাঠানোর পরামর্শ দেন প্রথম সচিব। এ সময় দূতাবাস কর্মকর্তাকে গালিগালাজ ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এজন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় পরের দিনের কনস্যুলার সেবা। বিপাকে পড়েন কয়েক শ সেবাপ্রত্যাশী প্রবাসী বাংলাদেশি।

এর আগে ১৬ আগস্ট ইউরোপের দেশ ইতালিতে পাসপোর্টের দাবিতে রাজধানী রোমের বাংলাদেশ দূতাবাসে দিনভর বিক্ষোভ করেন প্রবাসীরা। সংক্ষুব্ধ শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি চ্যানসারি কমপ্লেক্সে ঢুকে পড়েন। তারা সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। এতে প্রধান ফটকের দুটি দরজা ও মূল্যবান আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবশ্য তৎক্ষণাৎ ইতালির পুলিশ এসে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। পরে রাষ্ট্রদূতসহ দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে টানা সাড়ে ৪ ঘণ্টার দেনদরবার শেষে বিক্ষোভকারীরা ১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট না পেলে দলবদ্ধ আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে স্থানত্যাগ করেন। অবশ্য রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান জানিয়েছেন, বয়সসহ পাসপোর্টের তথ্য সংশোধনে দীর্ঘদিন ধরে কয়েক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি অনিয়মিতভাবে চ্যানসারি কমপ্লেক্স এলাকায় বিক্ষোভ করে আসছেন। তাদের অন্তত ৭০ শতাংশের বয়স ৬-১২ বছর কমানোর আবেদন রয়েছে। যা সরকারের বিদ্যমান নীতিমালা ও সিস্টেমে কভার করে না। ১৭ জুলাই কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার খলিলুর রহমানকে প্রকাশ্যে গালিগালাজ ও মারধর করেছেন হাইকমিশনেরই সাবেক কর্মচারী ইউসুফ হারুন। কানাডার অটোয়ার একটি পার্কে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ইউসুফ হারুনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে হাইকমিশন। ইউসুফ হারুনের অভিযোগ পাসপোর্ট আটকে রাখার ও ভোগান্তির।

সেবার দায়িত্ব ও দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা দূতাবাস কর্মকর্তারা কেন রোষানলে পড়ছেন- জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দূতাবাসগুলোয় যারা কাজ করছেন তারা হওয়ার কথা প্রবাসীদের সেবক। কিন্তু তাদের আচরণে তার কিছুই প্রকাশ পায় না। বরং তারা এমন রূঢ় আচরণ করেন যেন মনে হয় তারা রাজা এবং আমরা প্রজা। এ ধরনের আচরণ হলে ক্ষোভ হওয়াটা স্বাভাবিক।’ তিনি বলেন, ‘প্রবাসী কর্মী ও অন্যদের জন্য যখন খুব জরুরি কিছু একটা দরকার হয় তখনো তারা সমস্যা বোঝার চেষ্টা করেন না। ফোন তো তারা প্রায় ধরেনই না। প্রবাসীরা তো তাদের কাছে কোনো বিশেষ সাহায্য চাইছেন না, এটা তো তাদের অধিকার।’ অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, ‘প্রবাসীদের বক্তব্য অনুসারে কূটনৈতিক দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা অমানবিক আচরণ করেন। এও একক কোনো দেশে নয়, সেটা মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, জাপান, ইউরোপ, আমেরিকা সব দিকেই। যত দিন দেশের প্রতিনিধিত্ব করা এসব দূতাবাস কর্মকর্তা মানবিক ও সেবাবান্ধব না হবেন তত দিন প্রবাসীদের এ ক্ষোভ ও রোষানল বন্ধ করা কঠিন হবে।’ অপরাধবিজ্ঞানী ড. জিয়া রহমানের মতে, পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে এ ধরনের রোষানলের সৃষ্টি হতে পারে। কারণ দূতাবাসগুলোর বিরুদ্ধে কাক্সিক্ষত মানের সেবা না দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রবাসীদের সেভাবে দেখভাল করার কথা সব সময়ই শোনা যায়। আর যে-কোনো জায়গায় যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে তখন সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে খুব সহজেই। এক স্থান থেকে অন্য স্থানের প্রবাসীরা উদ্বুদ্ধ হয়েও এ কাজ করতে পারেন। দূতাবাসের কর্মকর্তারা যদি ব্যবহারের দিক থেকে সচেতন না হন তাহলে এ ধরনের ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বব্যাপী। অন্যদিকে এ ধরনের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে সরকারবিরোধীরাও কেউ কেউ ফায়দা লুটতে পারে। তাই দূতাবাস ও কূটনীতিকদের সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।’

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর