রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ফের উত্তপ্ত মিয়ানমার সীমান্ত

♦ আবারও গোলা নিক্ষেপ, দুই যুদ্ধবিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার নিয়ে মহড়া ♦ বিদ্রোহীদের হামলায় মিয়ানমারের ১৯ পুলিশ নিহত, উসকানিতে পা নয় ♦ সর্বোচ্চ সতর্ক বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক ও বান্দরবান প্রতিনিধি

ফের উত্তপ্ত মিয়ানমার সীমান্ত

সীমান্তে গতকাল মিয়ানমারের হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায় ছবি : সংগৃহীত

মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলা গতকালও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়েছে। গতকাল সকালে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় পড়ে। এ নিয়ে গত দুই সপ্তাহে তিন দফায় মিয়ানমারের গোলা এলো বাংলাদেশ সীমান্তে। এ কারণে সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবিকে রাখা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর, মিয়ানমারের কোনো উসকানিতে পা দেবে না বাংলাদেশ তবে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে রোহিঙ্গাদের নতুন করে অনুপ্রবেশ ঠেকাতেও। আজ ঢাকার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সকাল সাড়ে ৯টার সময় নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপির আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০-৪১-এর মাঝামাঝি স্থানে মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে সেনাবাহিনীর দুটি যুদ্ধবিমান এবং দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টার টহল দেয়। সে সময় তাদের যুদ্ধবিমান থেকে প্রায় ৮ থেকে ১০টি গোলা ছোড়া হয়। এ ছাড়া হেলিকপ্টার থেকেও আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৫টি গুলি করতে দেখা যায়। এ সময় সীমান্ত পিলার ৪০ বরাবর আনুমানিক ১২০ মিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা পড়ে। স্থানীয়রা জানান, নাইক্ষ্যংছড়ির ১ নম্বর ওয়ার্ডের তুমব্রু বিজিবি বিওপির সীমান্ত পিলার ৩৪-৩৫-এর মাঝামাঝি মিয়ানমার অংশে ২-বিজিবির তমব্রু রাইট ক্যাম্প থেকে চার রাউন্ড ভারী অস্ত্রের গুলি করা হয়।

ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, আবারও দুটি বিমান থেকে ছোড়া গোলা এসে সীমান্তে পড়েছে। তমব্রু সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির ঘটনায় গত রবিবার দুটি এবং বৃহস্পতিবার একটি মর্টার শেল সীমান্তের এপারে এসে পড়েছে। এ ছাড়া গতকাল থেকে দুটি হেলিকপ্টারকে ওপারে সীমানা ঘেঁষে টহল দিতে দেখা গেছে।’ এতে রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে বলেও জানান তিনি। বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তে টহল বাড়ানোর পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত ১০/১২ দিন ধরে সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলি হচ্ছে। এই ঘটনায় প্রথমদিকে তমব্রু এলাকার বাংলাদেশ সীমান্তের অংশে থাকা রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা আতঙ্কে থাকলেও বর্তমানে তাদের আতঙ্ক কিছুটা কেটেছে। বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, গোলা পড়ার ঘটনায় বিজিবি সর্তক অবস্থানে আছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। জেলা প্রশাসনসহ সবাই সতর্ক অবস্থানে আছে। বিজিবি সদর দফতরের পরিচালক (অপারেশনস) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ারমার সরকারের গোলাগুলি চলছে। মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলা বাংলাদেশে অভ্যন্তরে এসে পড়েছে বলে শুনেছি। আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। ঘটনাটি সত্য প্রমাণিত হলে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হবে। আমরা সতর্ক রয়েছি। এর আগেও মর্টার শেল উড়ে আসার ঘটনায় আমরা কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি। সীমান্তের লোকজন যাতে ভয়ে না থাকে সেজন্য বিজিবি কাজ করছে।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সহিংসতার খবর : মিয়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে আবারও সহিংসতা শুরু করেছে দেশটির সামরিক সরকার। রাখাইন রাজ্যের মংডুতে পুলিশ ফাঁড়ি দখল এবং ১৯ পুলিশ কর্মকর্তা নিহতের জেরে সীমান্ত এলাকায় বিমান হামলা শুরু করেছে মিয়ানমার জান্তা। ইরাবতী জানিয়েছে, গত বুধবার ফাঁড়িতে অতর্কিত হামলা চালায় আরকান আর্মির সশস্ত্র সদস্যরা। সেখানে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম জব্দ করে। সেই সঙ্গে ১৯ জন জান্তা পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে।

ওপারে গোলাগুলির শব্দে জনমনে উৎকণ্ঠা : সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে প্রচণ্ড গোলাগুলি, মর্টার শেল নিক্ষেপ ও হেলিকপ্টার থেকে ফায়ারিংয়ের প্রচণ্ড আওয়াজ সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ পূর্বাঞ্চল বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাধীন ঘুমধুম ইউনিয়নের রেজু, তমব্রু ও কোণারপাড়া এলাকার মাটি কাঁপিয়ে তুলছে। জিরো লাইনের কাছাকাছি কোণারপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমানে ৪ হাজারের মতো রোহিঙ্গা নাগরিক আশ্রিত রয়েছে। তাদের মধ্যে মিয়ানমারের বাহিনীর হামলার আশঙ্কা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, গত ৩ সপ্তাহ ধরে উভয়পক্ষের মধ্যে মরণঘাতী যুদ্ধ চলছে। দিনভর সামরিক হেলিকপ্টার থেকে নিচের বনাঞ্চল লক্ষ্য করে ব্যাপক ফায়ারিং হচ্ছে। এতে ভয় পেয়ে সীমান্তের এপারের বাগানচাষি ও শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন। আতঙ্কে বন্ধ হয়ে গেছে সীমান্ত সড়কের নির্মাণ কাজও।

গোলাগুলির আওয়াজে সীমান্ত সংলগ্ন রেজু গর্জনবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান প্রায় বন্ধের পথে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ হামজা জানান, বোমা হামলার ভয়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাইছেন না। ভয়ে আছি আমরাও। এরকম উৎকণ্ঠার মধ্যে সঠিকভাবে পাঠদান করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান প্রধান শিক্ষক। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু, রেজু আমতলী, বাইশফাঁড়ি, তুইঙ্গাঝিড়ি, গর্জনবুনিয়া ও রেজু পাড়া পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকার ওপারে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা সেদেশের বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মি (এএ) বিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। এর ফলে হতাহতের আশঙ্কায় এপারের জনজীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে, বোমা নিক্ষেপ ও ফায়ারিংকালে মিয়ানমারের সরকারি পক্ষ হেলিকপ্টারের পাশাপাশি ড্রোন ব্যবহার করছে।

উসকানিতে পা দেবে না বাংলাদেশ : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা কোনো উসকানিতে পা দিতে চাই না। কারণ এ ধরনের বিষয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারলে তাদের কৌশলগত কোনো ফায়দা হতে পারে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমরা যে সমস্যায় আছি, তার দায় আমাদের দিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আমরা সতর্ক। এমন হয়েছে, মিয়ানমারে সংঘাতে লিপ্ত বিদ্রোহিগোষ্ঠীকে সমর্থন করে যারা, তাদের দু-একজন সীমানা পেরিয়ে এদেশে এসেছেন, তাদের গ্রেফতার করে আমরা আবার মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সত্যিকারের উদ্দেশ্যটা জানে। আমরা চাই না আর কোনো রোহিঙ্গা বা মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আসুক। মিয়ানমার সীমান্তের চলমান ঘটনা প্রবাহ সরকার কূটনৈতিক মহলে জানিয়ে রাখবে।

 

 

সর্বশেষ খবর