শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
ডিজিটাল হুন্ডি নিয়ে সিআইডি

এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান, অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেছেন, গত এক বছরে ডিজিটাল হুন্ডিতে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা মার্কিন ডলারে পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন। মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের ৫ হাজার এজেন্টের মাধ্যমে এসব টাকা পাচার হয়েছে। তিনি বলেন, সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি অভিযান পরিচালনা করে ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। চক্রটি গত চার মাসে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাচার করেছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচারের আনুমানিক হিসাব পাওয়া গেছে। গতকাল বেলা ১২টায় রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব জানিয়েছেন অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া। সিআইডির অভিযানে গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- আক্তার হোসেন, দিদারুল আলম সুমন, খোরশেদ আলম ইমন, রুমন কান্তি দাস জয়, রাশেদ মাঞ্জুর ফিরোজ, হোসাইনুল কবির, নবীন উল্লাহ, জুনাইদুল হক, আদিবুর রহমান, আসিফ নেওয়াজ, ফরহাদ হোসাইন, আবদুল বাছির, মাহাবুবুর রহমান সেলিম, আবদুল আউয়াল সোহাগ, ফজলে রাব্বি ও শামীমা আক্তার। এরা হুন্ডির বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহারকারী এবং বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের এজেন্ট। তাদের কাছ থেকে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮০ টাকা, চার সিমে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার ২২৯ ইলেকট্রনিক মানি এবং ৩৪টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় চারটি মামলা করেছে সিআইডি। সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান বলেন, যারা বিদেশ থেকে অবৈধ পথে টাকা পাঠাচ্ছেন এবং দেশ থেকে টাকা গ্রহণ করছেন তাদের মনিটরিংয়ে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটরিং করছে। পাশাপাশি সিআইডির ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে। আর গ্রেফতার ১৬ জনের মধ্যে ছয়জন বিকাশ এজেন্ট, তিনজন বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর সেলস অফিসার, তিনজন বিকাশের ডিএসএস, দুজন হুন্ডি এজেন্ট, একজন হুন্ডি এজেন্টের সহযোগী এবং একজন হুন্ডি পরিচালনাকারী। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলার জন্য সরকার অত্যন্ত তৎপর। হুন্ডি সব সময় রিজার্ভের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের অর্থনীতির এ ঝুঁকি মোকাবিলায় হুন্ডি কার্যক্রমের বিষয়ে নজরদারি শুরু করে সিআইডি। অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার এবং দেশের বাইরে অবস্থানরতদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং অপরাধ করে আসছে। অপরাধীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজটি করে থাকে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে এবং দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদের দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপে আছে অর্থ পাচারকারী ও তাদের সহযোগীরা। তারা দেশীয় মুদ্রায় ওই অর্থ এমএফএস এজেন্টদের প্রদান করে। তৃতীয় গ্রুপ তথা এমএফএস এজেন্টরা বিদেশে অবস্থানকারীর কাছ থেকে প্রাপ্ত এমএফএস নম্বরে দেশীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে। এসব চক্র প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এমএফএস এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবা ব্যবসাসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির আগে কেন অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা গেল না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সিআইডি প্রধান বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ায় তাদের গ্রেফতার করা যায়নি। সিআইডির গোয়েন্দা তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা তথ্য মিল পাওয়ায় তাদের গ্রেফতার করা হয়। হুন্ডি ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গেও আমাদের একটি বৈঠক হয়েছে। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন।’ অভিযানে অংশ নেওয়া সিআইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিজিটাল হুন্ডির জন্য ব্যবহৃত দুটি অ্যাপসের খোঁজ পেয়েছেন তারা। সৌদিকেন্দ্রিক ব্যবহৃত হতো ইজিক্যাশ এবং ইতালিকেন্দ্রিক ব্যবহৃত হতো টিমআই এবং টপআপ টোয়েন্টিফোর ডট ইনফো নামের অ্যাপস। ইজিক্যাশ পরিচালিত হতো দুবাই থেকে। দুবাইয়ের এই অ্যাপস পরিচালনাকারীরা বছরে একটা অংশ সার্ভিস চার্জ নিতেন। এই অ্যাপসে সৌদিতে টাকা পাঠাতে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক এজেন্টরা জড়িত। আর ইতালিকেন্দ্রিক ব্যবহৃত টিএমআই এবং টপআপ টোয়েন্টিফোর ডট ইনফো নামের অ্যাপসটি সেখানে অবস্থিত প্রবাসী মিজান, তার স্ত্রী মিথিলা ও সুমন পরিচালনা করেন। ওই দেশে থাকা প্রবাসীরা সেখানকার মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট দোকান দেওয়া বাংলাদেশিদের কাছে গিয়ে দেশে পাঠানোর জন্য ওই দেশের মুদ্রা জমা দিতেন। আর ওই এজেন্ট দোকানদাররা তা টিএমআই এবং টপআপ টোয়েন্টিফোর ডট ইনফো অ্যাপসে সমপরিমাণ মুদ্রা আপলোড করতেন। প্রবাসীরা যার কাছে টাকা পাঠাবেন তার মোবাইল নম্বরও দিয়ে দিতেন। আর তা সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপগুলোর মনিটরে ভেসে উঠত। বাংলাদেশে থাকা মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনাকারী এজেন্টরা তাতে ক্লিক করলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে এদের মোবাইল নম্বর থেকে সঙ্গে সঙ্গে এ দেশে থাকা প্রবাসীর স্বজনদের মোবাইলে টাকা চলে যেত।

সর্বশেষ খবর