সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ডলার হবে ১০০ টাকার নিচে

নজরদারি ব্যাংক মানি এক্সচেঞ্জ ও বড় এলসিতে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়া, বিকল্প মুদ্রা চালুর ভাবনা, রুবলের প্রবেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, রাশিয়া-ইউক্রেনের গম তেল বিক্রি শুরু

আলী রিয়াজ

ডলার হবে ১০০ টাকার নিচে

বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়া, বিকল্প মুদ্রা চালুর ভাবনা, রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে গম ও তেল বিক্রিসহ বিভিন্ন কারণে ডলারের দাম নামতে শুরু করেছে। ডলার বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি, বড় এলসির প্রতি দৃষ্টি রাখা, রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার কারণে আগামী কিছুদিনের মধ্যে ডলারের দাম ১০০ টাকার নিচে নেমে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডলারের দাম মূলত নির্ভর করে বিশ্ব বাস্তবতার ওপর। বর্তমানে যুদ্ধের প্রভাব ভিন্ন মাত্রার দিকে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও। ব্যাংকার অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের একক দাপট কমেছে। বর্তমান ধারাবাহিকতায় শিগগিরই পরিস্থিতি বদলে যাবে। আমদানি ও রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সূত্রমতে, ডলার সংকট নিয়ে নানামুখী পদক্ষেপে দাম কমে আসছে। ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড দর হওয়ার পর এখন তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বড় বড় এলসিতে কঠোর নজরদারি আরোপ করেছে। বিলাসী পণ্য আমদানির ওপর বিধিনিষেধ দেওয়ার কারণে প্রায় ৩০ শতাংশ এলসি কমেছে। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের অংশ হিসেবে রাশিয়ান রুবল ব্যবহার করার জন্য প্রাথমিকভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশ্ববাজারে তেলের দর কমায় ডলার সরবরাহের ক্ষেত্রেও সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। ব্যাংকাররা বলছেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে দেশে ডলারের সংকট কাটিয়ে উল্টো উদ্বৃত্ত হবে। জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডলারের সংকট আছে এখন তা বলা যায় না। বর্তমান যে পরিস্থিতি সেটি আগামী দেড় থেকে দুই মাস থাকতে পারে। এখন এলসি পেমেন্ট আছে ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। নতুন এলসি যেহেতু কমেছে তাই আগামী দুই মাসের মধ্যে সংকট কাটিয়ে উঠে ডলার সারপ্লাস হবে। বলা যায়, আগামী নভেম্বর থেকে দেশে ডলার চাহিদার তুলনায় বেশি আসবে। তাই শঙ্কার কোনো কারণ নেই। তবে এ মুহূর্তে রেমিট্যান্স দর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ দরকার। কারণ রেমিট্যান্সে কিছুটা বেশি দিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে পরিস্থিতি সবই এখন অনুকূল। আগামীতে ডলারের কোনো ধরনের সংকট থাকবে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে চরম ডলার সংকট শুরু হয়। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দর নিয়ে বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের আর্থিক সংকট শুরু হয়। যার প্রভাবে বাংলাদেশ ভয়াবহ ডলার সংকটে পড়ে। ৮৭ থেকে ৮৮ টাকা দরের ডলার খোলাবাজারে ইতিহাসের রেকর্ড করে ১২০ টাকায় পৌঁছায়। এর পরই বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দর ১২০ টাকা থেকে ১০৭-১০৮ টাকায় নেমে যায়। সর্বশেষ গতকাল খোলাবাজারে এই দামেই বিক্রি হতে দেখা গেছে। আন্তব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ডলারের দর ৯৫ টাকা। তবে ব্যাংকগুলোতে ১০০ টাকা থেকে ১০২ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। এলসি খুলতেও একই দরে ব্যাংকে ডলার লেনদেন হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ডলার সংকটকে পুঁজি করে নানা ধরনের কারসাজিতে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিলাসী পণ্যের আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা ছাড়াও রেমিট্যান্স পাঠানোর ওপর কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করেছে। এর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। আগস্টে প্রবাসীরা ২০৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। প্রতি ডলার ১০০ টাকা হিসাবে ধরে প্রবাসীদের পাঠানো এ অর্থের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২১ সালের আগস্টে প্রবাসীরা ১৮১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। সে হিসাবে আগস্টে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে, যাদের কাছে ১০ হাজার ডলারের অতিরিক্ত জমা আছে তা দ্রুত ব্যাংকে বিক্রি করা। এর বেশি কারও কাছে ডলার পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেন থেকে খাদ্যপণ্য বিশ্ববাজারে লেনদেন শুরু হয়েছে। ফলে খাদ্যপণ্যের এলসির ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে রেট কমেছে। একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম কমে এসেছে বিশ্ববাজারে। এর সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য বা রাশিয়ার মতো দেশের বাইরে কোনো দেশ থেকে আমদানি করতে পারে কি না সেটি নিয়েও ভাবা হচ্ছে। এরই মধ্যে নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও আলজেরিয়া থেকে আমদানির কথা ভাবা হচ্ছে। এসব দেশ থেকে আমদানি হলে সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রা ব্যবহার করা হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ডলারের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ হিসেবে ডলারের ওপর চাপ কমাতে বিকল্প মুদ্রার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ রুবল ব্যবহার করার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে ভারত, চীন, জাপানের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যে রুপি, ইউয়ান ও ইয়েন ব্যবহার করার কথাও ভাবছে সরকার। এসব মুদ্রা ব্যবহার হলে ডলারের ওপর বড় ধরনের চাপমুক্ত হয়ে যাবে বাংলাদেশ। ব্যবসায়ীরাও দাবি করছেন, বৈদেশিক বাণিজ্যে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার হলে দেশের বাজার আরও বেশি সুবিধা পাবে। বাংলাদেশের উচিত সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করা। এসব কারণে খুব দ্রুত দেশের ডলারের বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ডলারের দর নিয়ে এবিবি ও বাফেদার সঙ্গে কথা বলেছি। আমাদের পূর্ণ নজরদারি রয়েছে। ডলার নিয়ে কোনো অস্থিরতা তৈরি যেন না হয় বা সংকট না হয় সে জন্য দুই সংগঠনের সঙ্গে মিলে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে রপ্তানি বিলের দর হবে ৯৯ টাকা এবং রেমিট্যান্সে বিল হবে এর চেয়ে একটু বেশি। এই দুই দর সমন্বয় করে একটি দর নির্ধারণ করে এর ওপর এক টাকা বেশি ধরে আমদানি এলসি খুলবে ব্যাংকগুলো। এলসি খোলার ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে অগ্রাধিকার থাকবে। পাশাপাশি কোনো ধরনের অপ্রয়োজনীয় বা লাক্সারি আমদানিতে আগে থেকে বিধিনিষেধ দেওয়া আছে। সেটি যাতে পূর্ণভাবে পরিপালন হয় সেদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজর রাখছে। এ ছাড়া ব্লুমবার্গ দর ঠিক রাখছে কি না সেটি নিয়েও আমরা কাজ করছি। কারণ আগে দেখা গেছে আন্তর্জাতিক দরের চেয়ে ব্যাংকগুলো বেশি দর নির্ধারণ করত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে আশা করছি দ্রুত ডলারের দর অনেক কমে আসবে।’

রপ্তানি বিল নিষ্পত্তিতে ডলারের দর ৯৯ টাকা : বৈদেশিক বাণিজ্যে ডলারের নতুন দর নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক, বাফেদা ও এবিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এ দর নির্ধারণ করা হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে, রপ্তানি আয় নগদায়ন করতে হবে সর্বোচ্চ ৯৯ টাকা দামে। আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারের দাম হবে সর্বোচ্চ ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা। এর আগে একেক ব্যাংক একেক রকম দামে বৈদেশিক বাণিজ্যের বিল নগদায়ন করত। তবে প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার আনতে প্রতি ডলারের জন্য সর্বোচ্চ দাম নেওয়া যাবে ১০৮ টাকা। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সভা অনুষ্ঠিত হয় সোনালী ব্যাংকের মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ে। সভায় বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিম এবং এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘সময়ে সময়ে এই দাম পরিবর্তন হবে। আশা করছি, এর মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। বর্তমানে ডলারের যে দাম, সে অনুযায়ী নতুন দাম নির্ধারণ হয়েছে। ফলে এর চেয়ে বেশি দাম বাড়ার কারণ নেই। বাজারভিত্তিক এ দাম বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যালোচনা ও তদারক করবে। তবে দাম নির্ধারণ হবে বাজারের ওপর ভিত্তি করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর