সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

৪২ লাখ মামলার পাহাড়

আরাফাত মুন্না

৪২ লাখ মামলার পাহাড়

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের ঈদ-পরবর্তী জনসভা শেষে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়া। চিকিৎসার জন্য ঢাকা নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান। ওই হামলায় আরও চারজন নিহত হন। আহত হন ৭০ জন। ঘটনার পরদিন আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেন। মামলার পর ১৭ বছর কেটে গেলেও শেষ হয়নি বিচারকাজ। শুধু কিবরিয়া হত্যা মামলাই নয়, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ এবং জমিজমার    বিরোধ-সংক্রান্ত প্রায় ৪২ লাখ মামলার পাহাড় জমে আছে সারা দেশের আদালতগুলোতে। দীর্ঘদিনেও মামলার বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের সময় ও অর্থ দুটোই নষ্ট হচ্ছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫৩টি। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০টি। দুটি হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু গত সাড়ে চার বছরেই জটের তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে ৬ লাখ ২৮ হাজার ৮০৩টি মামলা।

আইনজ্ঞরা বলছেন, বিচারক স্বল্পতার পাশাপাশি আইনের ত্রুটি, সাক্ষী হাজির না হওয়াই মামলাজটের অন্যতম কারণ। তারা বলেন, বিশাল এই মামলাজট কমাতে হলে আইনি কাঠামোর আওতায় আদালতের মধ্যস্থতায় (এডিআর) বাদী-বিবাদী এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে ছোটখাটো মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে মনোযোগী হতে হবে। একই সঙ্গে পুরনো আইনগুলো যুগপোযোগী করা জরুরি। পাহাড়সম এ মামলার জট কমাতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলেও অভিমত তাদের।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫৩টি। এর মধ্যে উচ্চ আদালতের উভয় বিভাগে (আপিল বিভাগ ও হাই কোর্ট) ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫৪৮টি। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ১৭ হাজার ৫৪৭ এবং হাই কোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ১৮ হাজার একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, আপিল বিভাগের বিচারাধীন মামলাসমূহের মধ্যে ১১ হাজার ৯৭৮টি দেওয়ানি, ৫ হাজার ৪৫৪টি ফৌজদারি এবং ১১৫টি আদালত অবমাননার অভিযোগে করা মামলা। অন্যদিকে হাই কোর্টের বিচারাধীন মামলাসমূহের মধ্যে ৮৯ হাজার ২০৭টি দেওয়ানি, ৩ লাখ ১২ হাজার ৬৫৯টি ফৌজদারি এবং রিট ও আদিম মিলিয়ে আরও ১ লাখ ১৬ হাজার ১৩৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৪ জেলার অধস্তন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৩৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫টি মামলা। অধস্তন আদালতে ২৪ লাখ ৩৩ হাজার ৭৩৬টি ফৌজদারি এবং ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬৭টি দেওয়ানি মামলার বিচার চলছে। নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলাসমূহের মধ্যে ২ লাখ ৯ হাজার ৫০৯টি মামলা অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

মামলাজট নিরসনে সুপ্রিম কোর্ট কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের এমন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে আট বিভাগের মামলা তদারকিতে হাই কোর্টের আটজন বিচারপতিকে প্রধান করে পৃথক আটটি মনিটরিং সেল গঠন করে দিয়েছেন তিনি। ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তিতে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০০০ সালের আগে দায়ের করা মামলাসমূহ চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই নিষ্পত্তি করতে প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।

কীভাবে হবে মামলাজট দূর : প্রায় ৪২ লাখ মামলার জট দেশের বিচার বিভাগের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়সহ এ মামলার জট নিরসনের কিছু পথ দেখিয়েছেন দুজন সুপরিচিত আইনজীবী।

জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মামলার জট যেভাবে বাড়ছে, তাতে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।’ তিনি বলেন, ‘মামলার জট দ্রুত নিষ্পত্তিতে এখন আর হালকা করে ভাবার সময় নেই। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। টাইম ফ্রেম করে বিচারকদের মামলা নিষ্পত্তির টার্গেট দিতে হবে। আমার মনে হয় ইচ্ছে করলে এটা করা সম্ভব।’ এ ছাড়া নতুন মামলা দায়ের ঠেকাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি।

সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, এডিআর দুভাবে করা যায়। মামলা দায়েরের আগেও করা যায়, আবার দায়েরের পরেও করা যায়। দুই পক্ষ যদি সম্মত থাকে, দেওয়ানি মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলাও এডিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। যে কোনোভাবে মামলার জট কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে পারলেই এই ‘অভিশাপ’ থেকে মুক্তি সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

জানতে চাইলে জনস্বার্থ মামলার আইনজীবী খ্যাত সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু পরিকল্পনা নয়, মহাপরিকল্পনা করে মামলাজট বৃদ্ধির প্রধান দুই কারণ নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের মামলাজট বাড়ার প্রধান দুই কারণ। একটি হচ্ছে আমরা মামলা দায়েরও ঠেকাতে পারছি না, অন্যটি দ্রুত নিষ্পত্তিও করতে পারছি না।’

মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘প্রশাসনিক যে সিদ্ধান্তগুলো আসে তা অধিকাংশই আইন অনুযায়ী হয় না। ফলে মামলা হয়। আবার ফৌজদারি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, অপরাধ করলে সাজা হবে এখন মানুষ আর সেই চিন্তাটাই করে না। ফলে সমাজে অপরাধ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফৌজদারি মামলাও বাড়ে।

এতে মামলা যেমন বৃদ্ধি পায়, ঠিক একইভাবে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করার সক্ষমতা আবার আমাদের নেই। অর্থাৎ যত সংখ্যক মামলা হচ্ছে, তা নিষ্পত্তির জন্য তত সংখ্যক আদালত, তত সংখ্যক বিচারক আমাদের নেই। তাই মামলা জট নিরসনে আমাদের দায়ের ও নিষ্পত্তি একসঙ্গে দুই দিকেই কাজ করতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর