বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

পঙ্কজ কি এমপি থাকছেন?

কী আছে সংবিধানে, নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা আলোচনা, হারিয়েছেন দলের সব পদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

পঙ্কজ কি এমপি থাকছেন?

বরিশাল-৪ আসনের এমপি পঙ্কজ নাথের (পঙ্কজ দেবনাথ) আসন কি শূন্য হতে চলেছে? গতকাল রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে ছিল আলোচনা। এর আগে এভাবে দলটি থেকে প্রথমে অব্যাহতি ও পরে বহিষ্কার হওয়ার পর এমপি পদ ছাড়তে হয়েছিল আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে।

 এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পঙ্কজ দেবনাথ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে। যুক্তি হিসেবে বলা যায়, দল বহিষ্কার করলে তার এমপি পদ থাকে না। কারণ, তিনি তো আওয়ামী লীগের সঙ্গে নাই। দল থেকে বহিষ্কার হলে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ ও আরপিওর ১২(১) বিধি অনুযায়ী তাদের এমপি পদ থাকবে না। এখন নির্বাচন কমিশন বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে, সেটা দেখার বিষয়।   তিনি বলেন, যে দল তাকে মনোনয়ন দিয়েছে, সেখান থেকে পদ হারালে সংসদে তার অবস্থান কোথায় হবে? এখন অন্য দলে যোগ দেওয়ার বা স্বতন্ত্র এমপি হয়ে থাকার সুযোগও নেই। কারণ, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার শর্ত তিনি পূরণ করেননি। সবকিছুর পরও সংসদ ও নির্বাচন কমিশনই পঙ্কজ দেবনাথের এমপি পদে থাকা বা না থাকার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন বলে মনে করেন এই আইনজীবী।

গত সোমবার বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসহ সব দলীয় পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত অব্যাহতি পত্রে উল্লেখ করা হয়- ‘আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদ সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অর্পিত ক্ষমতাবলে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আপনাকে আওয়ামী লীগ বরিশাল জেলা শাখার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদসহ দলীয় অন্য সব পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করেছে। উক্ত বিষয়ে আপনার লিখিত জবাব আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় দফতর বিভাগে জমা প্রদান করার জন্য সাংগঠনিক নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।’

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে এমপি পঙ্কজ দেবনাথের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ। তার বিরুদ্ধে গত চার বছরে দলকে বিভক্ত করে নিজের বলয় সৃষ্টি করে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দলীয় নেতা-কর্মীদের হত্যা, নির্যাতন, পঙ্গু করে দেওয়া, মিথ্যা মামলায় হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা এবং নৌকাকে হারানোর অভিযোগ তার রয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় প্রতিটি সংগঠন আলাদা করে ‘এমপি লীগ’ গঠনের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধে জড়ান বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ।

সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলে তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে এমন সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। কিন্তু দল যদি বহিষ্কার করে সেক্ষেত্রে তার সংসদ সদস্য পদ চলে যেতে পারে।

সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হওয়ার বিষয়ে সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে বেশ কিছু বিধান রয়েছে। এর মধ্যে ৬৭(১)(ঙ) এ বলা হয়েছে, ‘কোন সংসদ-সদস্যের আসন শূন্য হইবে, যদি এই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।’ আর আসন শূন্য হওয়ার বিষয়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি- (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’

গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ১২(১)খ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার বা থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনিত না হন বা একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী না হন।’

এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দল কোনো সংসদ সদস্যকে বহিষ্কার করলে তার সদস্য পদ কী হবে এটার উত্তর সরাসরি আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে নেই। ৭০ অনুচ্ছেদে দল থেকে পদত্যাগ অথবা দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার কথা বলা আছে। বহিষ্কারের বিষয়টি নিয়ে মামলা হলে তখন উচ্চ আদালত এ বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারেন। তবে আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা দাঁড়াবে পদত্যাগ ও বহিষ্কার শব্দটা সমর্থক কি-না। হাই কোর্ট হয়তো এটাই বলবেন যে, দল থেকে পদত্যাগ করা আর বহিষ্কার করা সমর্থক। তাহলে এই বিবেচনায় তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। তবে হাই কোর্ট কী বলবেন সেই সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, এমপি পঙ্কজ দেবনাথ যে ব্যাখ্যাই দিক এতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। পরবর্তীতে তার নামে বহিষ্কার চিঠি ইস্যু করা হতে পারে। দল থেকে বহিষ্কার করলে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ভাগ্য বরণ করতে হবে তাকে।

দলীয় সূত্র জানায়, সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ দুই উপজেলায় দলীয় রাজনীতিতে খুব একটা খাপ খাওয়াতে পারছেন না পঙ্কজ নাথ। তিনি দুটি উপজেলাসহ প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি করে নিজের বলয় তৈরি করেন। এটি নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ দূরত্ব শেষ পর্যন্ত দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। কেন্দ্রে পাঠানো লিখিত রেজল্যুশনে অভিযোগ করা হয়, পঙ্কজ নাথ তার নির্বাচনী এলাকা হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলায় দলের মধ্যে বিভেদ ও নিজের বলয় তৈরি করতে পুরনো এবং ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে রেখেছেন। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র দলীয় প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়া, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পরাজিত করতে খুন, দলীয় নেতা-কর্মীদের মারধর, কুপিয়ে জখম এবং জ্যেষ্ঠ নেতাদের অপমান-অপদস্ত করছেন।

১৭ সেপ্টেম্বর হিজলা ও ১৮ সেপ্টেম্বর মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা সম্মেলন সংঘাতের আশঙ্কা করে কেন্দ্রে পাঠানো রেজল্যুশনে জেলা আওয়ামী লীগ দাবি করে, পঙ্কজ নাথকে দলীয় পদে রেখে ওই দুই উপজেলায় সম্মেলন করা হলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা হতে পারে। দলের পুরনো ও ত্যাগী নেতা-কর্মীরা যোগ্য পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেন। সর্বশেষ ২৮ আগস্ট মেহেন্দীগঞ্জ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ছয় নেতা-কর্মীকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনাও এতে উল্লেখ করা হয়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর