বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ঝুঁকিতে শিল্পকারখানা

গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকে

নিজস্ব প্রতিবেদক

গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিল্প খাতের উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিশেষ করে টেক্সটাইল, সিরামিক, সিমেন্ট, ইস্পাত, সার এবং ইলেকট্রনিক্স নির্মাতারা বিপাকে পড়েছেন শিল্পের চলমান এই সংকট মোকাবিলায়। গ্যাসের চাপ কম ও নিয়মিত লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ব্যয় অন্তত ৫০-৬০ শতাংশ বেড়েছে। অপরদিকে অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনও কমে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিল্প খাত গভীর থেকে গভীরতম সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করেন শিল্প উদ্যোক্তারা।

প্রায় তিন বছর আগে শুরু হওয়া করোনা মহামারির আঘাতে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল দেশের শিল্প খাত। সে সময় বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে সরকার শিল্প খাতকে নানাভাবে সহায়তা দিলেও অনেক শিল্প উদ্যোক্তাই ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। করোনা মহামারির সেই আঘাত কেটে ওঠার আগেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে বিভিন্ন দেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। একই সঙ্গে ডলারের দাম বাড়তে থাকে হুহু করে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও বাড়তে থাকে। ফলশ্রুতিতে দেশের বাজারেও জ্বালানিসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। সংকট সামলাতে সরকার কিছু কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। এতে শিল্প খাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। যা এখনো অব্যাহত। ঘন ঘন লোডশেডিং ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে শিল্পের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। ফলে শিল্প-কারখানা চালু রাখাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। উদ্যোক্তারা অনেকেই লোকসান গোনার পথে হাঁটছেন। অনেকেই এ সংকটকে করোনাকালীন সংকটের চেয়ে ভয়াবহ সংকট হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনা মহামারির সময় দেশের সামগ্রিক শিল্প খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সেই বিপর্যয় কাটার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। যা এখনো চলমান। এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে তা হয়তো কেউই জানে না। দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প খাত। এতে একটা সময় শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে অনেকেই বাধ্য হবে কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো সিদ্ধান্ত নিতে। যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট আর লোডশেডিংয়ের কারণে একদিকে উৎপাদন কমেছে, অন্যদিকে ঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে পারছেন না অনেকেই। ফলে বিশ্ববাজারে ক্রয়াদেশ হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন অনেকেই। এ জন্য শিল্পসহ সব উৎপাদন খাতে উৎপাদন ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সরকারকে অনুরোধ করেছেন উদ্যোক্তারা। শিল্প মালিকরা বলছেন, উৎপাদন খাতও বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের সংকটে উৎপাদন খরচও বেড়েছে। এরপর সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে আরএকে সিরামিক, একটি শীর্ষস্থানীয় সিরামিক পণ্য প্রস্তুতকারক, প্রতিদিন ৯ লাখ বর্গমিটার টাইলস উৎপাদন করে। চলমান গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকটের মধ্যে এর উৎপাদন ৪ দশমিক ৫ লাখ বর্গমিটারে নেমে এসেছে এবং উৎপাদন খরচ ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। আরএকে সিরামিকের চিফ অপারেটিং অফিসার ও চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার সাধন কুমার দে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের কারখানায় আমরা দিনে ১২ ঘণ্টা গ্যাস পাই না। তারপর লোডশেডিংও হয়। ফলে উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমেছে। কিন্তু ৬০ শতাংশ আউটপুটের জন্য উৎপাদন খরচ একই রকম রয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যবশত, অতিরিক্ত খরচ খুচরা বাজারে সামঞ্জস্য করা যাচ্ছে না। ফলে কোম্পানি লোকসান গুনতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের কোম্পানির কোনো ব্যাংক ঋণ না থাকায় আমরা টিকে থাকতে পেরেছি। যাদের ব্যাংক ঋণ নির্ভর তারা হয়তো আরও বেশি সংকটের মধ্যে রয়েছেন। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমি এই মুহূর্তে দেশের বাইরে অবস্থান করছি। ক্রেতাদের সঙ্গে নেগুসিয়েশন করতে আমাদের এখন বেশ কষ্টই হচ্ছে। কেননা একদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক। অন্যদিকে কাঁচামালের দাম বেশি। উৎপাদন খরচও উচ্চ। এ ছাড়া গ্যাস বিদ্যুতের সংকটের কারণে উৎপাদন কমে গেছে। ফলে সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি দেওয়াও সম্ভব হয় না কোনো কোনো সময়। এর ফলে ক্রেতারা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। আমরা অর্ডার হারাচ্ছি। এটা ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক এক অশনি সংকেত বলে মনে করেন তিনি। এদিকে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, ইউক্রেনের যুদ্ধের আলোকে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার সংকটের কারণে সরকার খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে গ্যাস সরবরাহ কমেছে ৭-৮ দশমিক। এরপর জ্বালানি সংকটের কারণে সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে এবং লোডশেডিং বেড়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় মতে, গ্যাসের বর্তমান দৈনিক সরবরাহ ২,৭৯৭ এমএমসিএফ যা সংকটের আগে জুন মাসে ৩১০০ এমএমসিএফ ছিল। মোট সরবরাহের মধ্যে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ বা ৪৪০ দশমিক ৮০ এমএমসিএফ গ্যাস শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয় এবং ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ বা ১৫৩ এমএমসিএফ সার কারখানায় এবং ৪২ দশমিক ৯৯ শতাংশ গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, শিল্প খাত প্রতিদিন মোট সরবরাহের ২৮ শতাংশ ব্যবহার করে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ৯,৬০০-১১,৭০০ মেগাওয়াট, যা সংকটের আগে ছিল ১১,১০৫-১২,৯৫১ মেগাওয়াট। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের মোট রপ্তানির ৫৬ শতাংশই উৎপাদন খাত থেকে। আর সরকার এই খাতের ওপর ভিত্তি করে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু চলমান সংকটে সময়মতো পণ্য ডেলিভারি করতে না পারলে অর্ডার চলে যাবে অন্য দেশে। তাই সরকারের উচিত উৎপাদন ক্ষমতা বিচার করে সে অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বরাদ্দ করা। এ ছাড়া দেশের অন্য বড় গ্রুপ অব কোম্পানিগুলোও ভার্টিক্যাল রোলার মিল (ভিআরএম) প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিমেন্ট উৎপাদন করছে, যা কম খরচে সিমেন্ট উৎপাদনের অনুমতি দেয় কিন্তু জ্বালানি হিসেবে বিদ্যুৎ এবং গ্যাস উভয়ই প্রয়োজন। এখন, উভয়েরই সরবরাহের সংকট উৎপাদনকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে বাধ্য করেছে। এসব কোম্পানি দৈনিক তিন শিফটে চলত। কিন্তু দুই মাস ধরে গ্যাসের চাপ না থাকায় এক বা দুই শিফট চালাতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এসব কোম্পানি লোকসানের মুখে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর