বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
করতোয়ায় নৌকাডুবি

এক দুর্ঘটনায় এত শিশুর মৃত্যু!

২১ শিশুসহ মৃত বেড়ে ৬৮, উদ্ধারে সম্প্রীতির নজির

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

এক দুর্ঘটনায় এত শিশুর মৃত্যু!

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় ইঞ্জিনচালিত নৌকাডুবির ঘটনায় গতকাল বিকাল পর্যন্ত ৬৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ভোর থেকে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ডুবুরি দল লাশ উদ্ধারে কাজ করে। তাদের সঙ্গে কাজ করছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা। গতকাল ১৭ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা হলেন সনেকা (৫৭), হরিকিশোর (৪৫), শিল্টু বর্মণ (২৮), মহেন চন্দ্র (৩০), ভূমিকা রায় পূজা (১৫), আঁখি রানী (১৬), সুমি রানী (৩৪), পলাশ চন্দ্র বর্মণ (১৭), ধৃতি রানী (১০), সজীব রায় (০৮), পুতুল (১৫), কবিতা (১১), যত্না রানী (৪০), মলিন্দ্রনাথ বর্মণ (৫৬), মণিভূষণ বর্মণ (৪৬), মুনিকা (৩৮), দোলা রানী (৫)। সরকারি তথ্য মতে আরও চারজন নিখোঁজ রয়েছে। রবিবার দুপুরে উপজেলার মারেয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকার করতোয়া নদীতে শতাধিক যাত্রী নিয়ে নৌকাটি ডুবে যায়।

এদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করেছে এলাকাবাসী। মারেয়া এলাকার শত শত তরুণ লাশ উদ্ধারে কাজ করেছেন। এরা বেশিরভাগই মুসলিম সম্প্রদায়ের। ঘটনার পর পরই সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এগিয়ে আসেন। তারা লাশ উদ্ধারে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনেককে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন। পরে জীবন বাজি রেখে পানিতে ডুব দিয়ে লাশ উদ্ধার শুরু করেন। ঘটনার দিনই প্রায় ২৫টি লাশ উদ্ধার করেন তারা। আরাজি শিকারপুর এলাকার জমিদার বর্মণ জানান, মুসলিম ভাইয়েরা নিজের ভাইয়ের মতো আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমরা তাদের ওপর সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। ফায়ার সার্ভিসের রংপুর বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জানান, পঞ্চগড়, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহী থেকে ১২টি ডুবুরি দল সকাল থেকে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে ভাটি অংশের ২৫/৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত অভিযান চালানো হচ্ছে। গতকাল ১৭টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত উদ্ধার ৬৮ লাশের মধ্যে নারী ৩০, শিশু ২১ এবং পুরুষ ১৭। এদের মধ্যে দেবীগঞ্জ উপজেলার ১৭, বোদা ৪৫, আটোয়ারী ২, ঠাকুরগাঁও সদর ৩ এবং পঞ্চগড় সদরের ১ জন। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার এবং রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। আজ (বুধবার) তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করার কথা রয়েছে।

ছোট ভাই টেনে তুলেছে বড় বোনকে : বড় বোন ডুবতে থাকার সময় ছোট ভাই টেনে তুলেছে বড় বোনকে। মারেয়া বামুন হাট ইউনিয়নের সরদারপাড়া গ্রামের কৈলাস চন্দ্র রায় এবং সুচিত্রা রানীর দুই সন্তান ঈশিতা কলি রায় এবং তর্পণ রায়। তারা মারেয়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বোন ঈশিতা এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। তর্পণ পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। বড় বোন ঈশিতা জানায়, আমি সাঁতার জানতাম। কিন্তু ওড়না দিয়ে আমার দুই পা আটকে থাকায় আমি ডুবছি আর উঠছি।

আর সবাইকে ডাকছি। এমন সময় আমার ছোট ভাই তর্পণ আমার হাত ধরে টানতে থাকে। আমাকে একটি নৌকার কাছে নিয়ে আসে। পরে নৌকায় উঠি। ছোট ভাই তর্পণ জানায়, নৌকাটা ডুবতে থাকলে আমি সাঁতার কাটতে থাকি। পাশে আমার বোন হাবুডুবু খাচ্ছে। আর চিৎকার করে লোকজন ডাকছে। আমি তখন বোনের একটি হাত ধরে ফেলি। তারপর তাকে টানতে থাকি। একটি নৌকা এগিয়ে আসে। আমরা নৌকায় উঠে পড়ি।

মিলল দুই বোনের লাশ : কাকিমার সঙ্গে পূজা দেখতে যাচ্ছিল পুতুল এবং কবিতা। মন্দিরে যাওয়া হয়নি তাদের। তার আগেই করতোয়া কেড়ে নিয়েছে এই দুই শিশুর প্রাণ। তারা দুই বোন। ঘটনার দুই দিন পর তাদের লাশ মিলেছে ঘটনাস্থলেই। বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের গোবিন্দ গুরু উচ্চবিদ্যালয়ে পুতুল অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। তার ছোট বোন কবিতা পড়ত ওই এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তৃতীয় শ্রেণিতে।

সম্প্রীতির নজির : ঐতিহাসিক বদেশ্বরী মন্দিরে প্রতিবছর মহালয়ার দিনে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন বিভিন্ন এলাকা থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

উদ্ধার কর্মীরা জানান, প্রথম দিন ২০ থেকে ২৫ জন নদীতে নামেন। এ সময় চা শ্রমিকরাও নদীতে নেমে উদ্ধার কাজে যোগ দেন। মাছ ধরা জেলেরাও উদ্ধারে কাজ করেন। পরদিন স্থানীয় শতাধিক মানুষ নেমে যান নদীতে লাশ উদ্ধার করতে। তৃতীয় দিনও স্থানীয়রা নদীতে নেমে লাশ খুঁজতে থাকেন। তারা ডুবুরি দল এবং ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে একাকার হয়ে কাজ করেন।

কমলাপুকুরী এলাকার ইকবাল জীবিত উদ্ধার করেন সজীব রায় এবং তার স্ত্রীকে। ওইদিনই সজীবের ছেলের লাশ উদ্ধার করেন স্বেচ্ছাসেবী এই উদ্ধারকর্মীরা। সজীব রায় জানান, স্থানীয়রা না হলে মরে যেতাম। কিন্তু ছেলেকে বাঁচাতে পারিনি।

সরদার পাড়া এলাকার জেলে বাবুল হোসেন জানান, দুজন জীবিত এবং চার লাশ উদ্ধার করেছি। সমাজকর্মী সারোয়ার হোসেন জানান, দ্বিতীয় দিন আমরা দল বেঁধে নদীতে নেমে পড়ি। নদীর গভীরে ডুবে লাশ উদ্ধার করি। অনেক লাশ হাত কাটা গেছে। অনেকের পা নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকের শরীরে পচন ধরেছে। অনেকের শরীর ফুলে গেছে। অনেক লাশ থেকে বিকট গন্ধ বের হচ্ছিল। অনেককেই চেনা যাচ্ছিল না। কখনো কাউকে হিন্দু-মুসলিম মনে হয়নি। স্থানীয় তরুণ উদ্ধার কর্মীরা গভীর রাত পর্যন্ত নদীর পানিতে ডুব দিয়ে লাশ উদ্ধার করতে থাকেন। জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় এমন মানুষজন বলছেন- স্থানীয় ওই তরুণরা পানিতে না নামলে তারা বাঁচতে পারতেন না।

সর্বশেষ খবর