সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

উদ্ধার নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

উদ্ধার নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা

চট্টগ্রামে রেললাইনের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে স্থাপনা

চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী স্টেশনের দক্ষিণ অংশ এবং গোয়ালপাড়া তুলাতলী রোড-সংলগ্ন এলাকায় মার্চ মাসে অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ৪০৩টি অবৈধ স্থাপনা ও ৩ হাজার ৬৫১ জন অবৈধ বসবাসকারীকে উচ্ছেদ করে ৩ দশমিক ৩৩৮ একর জায়গা উদ্ধার করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এক মাস পার হওয়ার আগেই ফের বেদখল হয়ে যায় উচ্ছেদকৃত স্থানটি। এর আগেও একই জায়গা একাধিকবার উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ফলে রেলওয়ের জায়গা নিয়ে চলছে দখল-বেদখল ও উচ্ছেদ খেলা। রেলওয়ের জায়গা উচ্ছেদ করা হলেও তা রক্ষা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্ছেদকৃত জায়গা পরে রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবে আবারও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ আছে, সরকারি জায়গা দখল করার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই আছে। সামান্য অংশ ইজারা নিয়ে আশপাশের জায়গা দখল করে নেওয়ার ঘটনাও কম নয়। এ সুযোগটি কাজে লাগাতে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা রেলের জায়গা দখলের প্রতিযোগিতায় নামেন। ক্রমেই রেলের জায়গা দখল করে তৈরি করা হয় নানা স্থাপনা। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভূসম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রায় সাড়ে ২১ হাজার একর ভূমি আছে। এর মধ্যে ২৫২ দশমিক ৫৫ একর ভূমি বেদখলে আছে। তবে অভিযোগ আছে, বাস্তবে এর চেয়ে বেশি ভূমি বেদখলে। পূর্বাঞ্চল রেলের অপারেশনাল কাজে ব্যবহার করছে ১৩ হাজার ৭৮৯ দশমিক ৫০ একর। এ ছাড়া ইজারা দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ১০৩ দশমিক ৬৬১ একর ভূমি। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অধীনে আছে- চট্টগ্রাম বিভাগ, সিলেট বিভাগ, ময়মনসিংহ বিভাগ ও ঢাকা বিভাগ। দখলের তালিকায় আছে সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা, রাজনৈতিক দলের কথিত কার্যালয়, ক্লাব, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, প্রভাবশালীদের বস্তি ও মার্কেট। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, ‘রেলওয়ের জায়গা নানাভাবে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলগুলো অবৈধভাবে বেদখল করে ফেলে। তবে জায়গাগুলো উদ্ধারে আমরা নিয়মিতই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে থাকি। কিন্তু উচ্ছেদের পর জায়গাটি রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো সক্ষমতা না থাকায় আবারও তা বেদখল হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘নানা সংকট-সমস্যা নিয়েই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে আছে- আর্থিক, জনবল, যানবাহন ও উচ্ছেদে ব্যবহৃত উপকরণ। এ ছাড়া রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাউকে পুনর্বাসন করার সুযোগ নেই। ফলে উচ্ছেদের সময় পুনর্বাসনের শর্ত দিয়ে দেয় অনেকে। তখন আমরা উচ্ছেদে বাধাপ্রাপ্ত হই।’  

এক বছরে ৪৮ একর ভূমি উদ্ধার : রেলওয়ের জায়গা প্রতিনিয়তই বেদখল হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিনিয়তই উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ৪২টি অভিযান পরিচালনা করে ৪৮ দশমিক ১৬৮ একর জায়গা উদ্ধার করে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২১টি অভিযানে ৩৮ দশমিক ৯১ একর এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ২১টি অভিযানে ৯ দশমিক ২৫৮ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়। তবে সব জায়গা রক্ষা করতে না পারায় আবারও বেদখল হয়ে যায়। মেলে না উচ্ছেদের সুফল।’

রেলের সম্পদ রক্ষায় যত চ্যালেঞ্জ : রেলের জায়গা রক্ষণাবেক্ষণে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় কর্তৃপক্ষকে। এর মধ্যে আছে অর্থ ও জনবল সংকট, স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের অপতৎপরতা, উচ্ছেদের পর রক্ষণাবেক্ষণে উদ্যোগে অর্থ বরাদ্দ সংকট, জায়গা ঘিরে রাখার বিষয়টি স্থায়ী করতে না পারা, রেলের জায়গায় জোরপূর্বক সড়ক ও স্থাপনা তৈরি করে ফেলাসহ নানা চ্যালেঞ্জ। তবে কিছু স্থানে উচ্ছেদের পর কাঁটাতার কিংবা সীমানা-দেয়াল দেওয়া হলেও অনেক স্থানে তা করা হয় না। অনেক স্থানে কাঁটাতার ফেলে দেওয়া হয়। ফলে আবারও উচ্ছেদকৃত জায়গাটি পুনর্দখল করেন ফেলে প্রভাবশালীরা।

উচ্ছেদে অপ্রতুল বরাদ্দ : প্রতিনিয়তই রেলের জায়গা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব জায়গা উচ্ছেদ করে ফিরিয়ে আনতে দরকার হয় অর্থের। তবে উচ্ছেদের ব্যাপারে অর্থ সংকটটা বড় অপ্রতুল। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ঢাকা বিভাগে বরাদ্দ ছিল ২০ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগে বরাদ্দ ছিল ১০ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছরে চট্টগ্রাম বিভাগে বরাদ্দ ছিল ৫ লাখ টাকা।

দখল নিয়ে হত্যাকান্ড : চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী এলাকায় মোটর মেকানিক মো. ফরিদুল আলম রেলওয়ের জায়গা দখল করে দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছিলেন। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে তৈরি হয় বিরোধ। বিরোধের জেরে হত্যাকান্ডের ঘটনাও ঘটেছে। এসবের বিরোধে ৭ মে ফরিদকে হত্যা করা হয়। হত্যার পরদিন ৮ মে রাতে ফরিদের বোন রাশেদা আক্তার ডবলমুরিং থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। এ মামলায় দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। স্থানীয়দের অভিযোগ, আসামিরা এলাকায় রেলওয়ের জমির দখল-বাণিজ্যে জড়িত।

সরেজমিন : সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরের রেলওয়ে স্টেশন-সংলগ্ন আইস ফ্যাক্টরি রোড, কদমতলী, পাহাড়তলী, টাইগার পাস, খুলশী, আমবাগান, আকবর শাহ, ফয়’স লেকসহ বিভিন্ন এলাকায় রেলওয়ের অনেক জমি দখলে নিয়ে বহুতল ভবন, মার্কেট ও বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। রেলের জমিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। দখল থেকে রক্ষা পায়নি রেললাইনের আশপাশের খালি জায়গা, পাহাড়, টিলাও। দখলের পাশাপাশি রেললাইনের দুই ধারে গড়ে তোলা হয়েছে মাদকের আখড়া।

অন্যদিকে কর্মচারীদের বসবাস করতে দেওয়ার জায়গায় স্থাপনা তৈরি করে দেওয়া হয় ভাড়া। বিভিন্ন জায়গা দখল করে ভাড়া দিয়ে রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মচারী আয় করছেন কোটি কোটি টাকা। রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে জানান, স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকেই একশ্রেণির দখলদার প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম রেলের জমি দখল করে রাখে। আবার একশ্রেণির সিন্ডিকেট আছে, যারা কিছু অংশ লিজ নিয়ে বড় একটি অংশ দখল করে রেখেছে। এভাবে যুগের পর যুগ রেলের ভূমি গিলে খাচ্ছে কিছু অসাধু চক্র। রেলের জায়গা দখল এবং আধিপত্য নিয়ে হয় বিরোধ, হয় খুনখারাবি। অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশলবিধি মতে, রেলপথের দুই ধারে খালি জায়গা থাকা আবশ্যক। নিরাপদ দূরত্ব হিসেবে কমপক্ষে ১৪.৩ ফুট এবং সর্বোচ্চ ৩০ ফুট জায়গা খালি রাখতে হয়। এর মধ্যে কোনো স্থাপনা তৈরি করলে বিনা নোটিসে তা গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়। অথচ চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় চট্টগ্রাম-দোহাজারী ও চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেলপথের দুই পাশ ঘেঁষে শত শত স্থাপনা বিদ্যমান।

সর্বশেষ খবর