বুধবার, ১২ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

বৈশ্বিক সংকটে ঘি ঢালছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতি, খাদ্য সংকটের মুখে বিশ্ব

মানিক মুনতাসির

করোনা মহামারি শেষ হওয়ার আগেই শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। এই যুদ্ধ যতটা দীর্ঘায়িত হবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ততটাই খারাপ হবে- বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি ও দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান বিশ্লেষকরা এমন আশঙ্কা করেছিলেন আরও আগেই। এখন এরই বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। স্বর্ণ ও জ্বালানি তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী দেশগুলোর মধ্যে মতভেদ এবং বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিশ্বের সর্বত্র। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। এই ক্ষতি দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে নিয়ে যাচ্ছে নাজুকতার দিকে, আর বিশ্বকে ধাবিত করছে দুর্ভিক্ষের দিকে- এমনটাই মনে করছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা। এমনকি বিশ্ব খাদ্য সংস্থাও বিশ্ববাসীকে আগাম সতর্ক করেছিল আসন্ন মন্দা ও দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে। সময় যত গড়াচ্ছে সংকট ততটাই বাড়ছে, বিশ্ব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ভয়াবহ এক মন্দার দিকে- এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ফলে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। বাংলাদেশেও গত ১০ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে মূল্যস্ফীতি, যা দুই অঙ্ক ছুঁই ছুঁই করছে। বিশ্বব্যাংক গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, অর্ধশতাব্দীর সবচেয়ে পড়তি সময় পার করছে বিশ্ব অর্থনীতি। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকুচিত হবে অন্তত দশমিক ৪ শতাংশ। ১৯৭০ সাল থেকে মন্দা-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের পর বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে মন্থর অবস্থায় রয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। অর্থাৎ ১৯৭০ সালের পর বৈশ্বিক অর্থনীতি এতটা ধাক্কার সম্মুখীন হয়নি। আগামী বছর যার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিশ্ব। আসছে বছরের সম্ভাব্য ওই অর্থনৈতিক মন্দায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। বৃহস্পতিবার ‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ওই প্রতিবেদনেই এসব আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। দেশ দুটি রীতিমতো বৈশ্বিক সংকটের এই জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালছে, যার মাশুল দিচ্ছে পুরো বিশ্ববাসী- এমনটাই মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সামনে যে পরিস্থিতি আসছে তা উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। এ জন্য টেকসই বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানমুখী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে বিশ্বব্যাংক। এতে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে।’ গতকাল থেকে ওয়াশিংটনে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ গ্রুপের বার্ষিক সভায়ও এ প্রসঙ্গে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা তো এই সংকটকে শতাব্দীর ভয়াবহতম সংকট হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিল্প-বাণিজ্য সংস্থা আঙ্কটাডের সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বেই ব্যবসা ও বিনিয়োগের গতি মন্থর এবং এটি ক্রমান্বয়ে মন্থর হচ্ছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে বিশ্ববাণিজ্য।  তখনো করোনা মহামারির প্রভাব বিদ্যমান ছিল। সারা বিশ্বেই যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে। এর ফলে ক্রমবর্ধমান খাদ্য, জ্বালানি ও আর্থিক সংকট ও মৌলিক পণ্যের দাম মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির প্রতিকূলতা আসছে বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য নিম্নগামী চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করে আঙ্কটাড। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম যুক্তরাজ্যে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিল্পোন্নত জার্মানিতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে জ্বালানি সংকটে। রিজার্ভ সংকটে দেউলিয়া হওয়ার পথে ছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশের মতো মজবুত অর্থনীতিও প্রবল ধাক্কা খেয়েছে ডলার ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে। তবে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল সংকট এখনো শুরু হয়নি। ভয়াবহ একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দ্বারপ্রান্তে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এটি শুরু হতে পারে এবং আগামী বছরজুড়ে অব্যাহত থাকতে পারে। এবারের মন্দা ২০০৮ সালের তুলনায়, এমনকি কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহ হতে পারে। এতে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে বিশ্ব। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, বৈশ্বিক ভোক্তা আস্থা ইতোমধ্যে আগের বৈশ্বিক মন্দার তুলনায় অনেক বেশি তীব্রভাবে পতনের সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরো অঞ্চল তীব্রভাবে মন্থর হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে, এমনকি পরের বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি মাঝারি আঘাত এটিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে উন্নয়নশীল দেশগুলো। সামনের দিনে আসন্ন এ সংকটের সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে মূল্যস্ফীতিকে। বিশ্বের প্রায় সব দেশই বর্তমানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রায় ব্যর্থ হতে চলেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংকট হবে কিছু কম। বৈশ্বিক এ সংকটের মধ্যেও এ অঞ্চলের দেশগুলো মোটামুটি ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবে।

সর্বশেষ খবর