রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

লাখ লাখ মামলা প্রশ্নবিদ্ধ

তুহিন হাওলাদার

লাখ লাখ মামলা প্রশ্নবিদ্ধ

নতুন সড়ক পরিবহন আইনে সব অপরাধ আমলযোগ্য হওয়ায় আইনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ট্রাফিক সিগন্যাল ভাঙা বা অবৈধ পার্কিং করার মতো ছোট অপরাধও আমলযোগ্য হওয়া এ আইনের বড় ভুল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণেই নতুন সড়ক পরিবহন আইনের ১১৭ ধারা দ্রুত সংশোধন করে ভুলত্রুটিমুক্ত করা জরুরি মনে করেন আইনজীবীরা। পুলিশ বলছে, বিদ্যমান আইনে ট্রাফিক পুলিশ সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারে না। এটি আদালতের বিচার্য বিষয়। কোনো চালক এ আইনে অপরাধ করলে তাকে থানা পুলিশের মাধ্যমে আদালতে পাঠাতে হয়। আইন অনুযায়ী আদালতই শাস্তির আদেশ দেন। বাস্তবে এ ধরনের আইনের কোনো প্রয়োগ হচ্ছে না। আইন হওয়ার চার বছর পার হয়ে গেলেও বিধিমালা না হওয়ায় আইন প্রয়োগে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনের কারণে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন আইনটি পাস হয়। পরে এ আইন কার্যকর হওয়ার শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লাখ লাখ মামলা ত্রুটিপূর্ণ বলে মত এসেছে আদালত থেকে। ট্রাফিক পুলিশ সূত্র জানান, ২০২১ সালে সারা দেশে মোটরযান আইনে মামলা হয়েছে মোট ৯ লাখ ৫৫ হাজার ৯১২টি। এসব মামলায় ২২১ কোটি ৭ লাখ ৩১ হাজার ৪১৪ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এ ছাড়া ২০২০ সালে সারা দেশে মোটরযান আইনে মোট মামলার সংখ্যা ৬ লাখ ১৩ হাজার ১৯। জরিমানার পরিমাণ ৭৭ কোটি ২৭ লাখ ৮৬ হাজার ২৫৬ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে সারা দেশে মামলার সংখ্যা বেড়েছে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৮৯৩। আর জরিমানা আদায় বেড়েছে ১৪৩ কোটি ৭৯ লাখ ৪৫ হাজার ১৫৮ টাকা। নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হওয়ার পর সারা দেশে চলতি বছর জুন পর্যন্ত প্রায় ২০ লাখ মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। আইনজীবীরা মনে করেন, এ ২০ লাখ মামলাই আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আইন অনুসারে সড়ক পরিবহন আইনের মামলাও থানায় হওয়ার কথা। কিন্তু এত বেশিসংখ্যক মামলা থানায় হলে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির সীমা ছাড়িয়ে যাবে। এ কারণে আপাতত পুলিশ সড়ক পরিবহন আইনের মামলা থানায় দায়ের করছে না। আবার এ মামলার প্রসিকিউশন প্রতিবেদন আদালতও গ্রহণ করছে না। ফলে জরিমানা আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রাষ্ট্র। সড়ক পরিবহন আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আইন অমান্য করার প্রবণতাও বেড়েছে। আদালতসূত্র জানিয়েছেন, নতুন পরিবহন সড়ক আইনের ভুলের বিষয়টি নজরে এলে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে ঘটনার বিষয় উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম চৌধুরী। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ১১৭ ধারা অনুযায়ী সব অভিযোগ আমলযোগ্য। কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে, ওই আইন পাস হওয়ার পরও আগের মতোই অসম্পূর্ণ প্রসিকিউশন প্রতিবেদন আদালতে পাঠানো হচ্ছে, যা আইন পরিপন্থী। চিঠিতে এ আইনের অধীনে মামলা রুজু, রুজুকৃত মামলা ও তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে প্রেরণ প্রক্রিয়ার বিষয়ে আগামীকাল সোমবার ঢাকা মহানগরী এলাকার সব উপ-পুলিশ কমিশনারকে (ট্রাফিক) ঢাকার সিএমএম আদালতের কনফারেন্স রুমে আলোচনার জন্য উপস্থিত হতে অনুরোধ জানিয়েছেন সিএমএম রেজাউল করিম চৌধুরী।

এ ছাড়া সম্প্রতি সড়ক পরিবহন আইনে মানিকগঞ্জে করা আরও একটি মামলার বিষয়ে আদালতের আদেশে নানা অসংগতি উঠে এসেছে। ওই আদেশে আইন লঙ্ঘনের দায়ে মামলা দায়েরকারী ট্রাফিক সার্জেন্ট ও প্রসিকিউশন প্রতিবেদন অগ্রগামীকারী টিআইকে সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। ওই আদেশে বলা হয়, নন এফআইআর মামলাটি সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ৯২(১) ধারায় দায়ের হয়েছে। কিন্তু এ ধারা লঙ্ঘন করা একটি ধর্তব্য অপরাধ (বড় অপরাধ)। এ ক্ষেত্রে নন এফআইআর প্রসিকিউশন রিপোর্ট দাখিলের কোনো সুযোগ নেই। প্রসিকিউশন রিপোর্ট দাখিল করে সার্জেন্ট মো. হাফিজুর রহমান এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ করেছেন; যা তার আইনি জ্ঞানের অভাব এবং দায়িত্বে অবহেলা বলে আদালত মনে করেন। অন্যদিকে টিআই (প্রশাসন) প্রসিকিউশন রিপোর্ট অগ্রগামী করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সড়ক পরিবহন আইন পাঠ বা পর্যালোচনা করেছেন, এমনটি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়নি। টিআই (প্রশাসন)-এর কাজ স্রেফ কারণিক নয়। তিনি মামলার প্রসিকিউশন রিপোর্ট দাখিলকারী কর্মকর্তার এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে সম্পাদন করা প্রসিকিউশন রিপোর্ট কোনোরূপ পাঠ বা পর্যালোচনা না করেই অগ্রগামী করেছেন। এ কারণে সার্জেন্ট মো. হাফিজুর রহমান ও টিআই (প্রশাসন) মানিকগঞ্জকে সাত দিনের মধ্যে ধর্তব্য অপরাধে কীভাবে প্রসিকিউশন রিপোর্ট দাখিল করা হলো, সে বিষয়ে সশরীরে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আইনে অস্পষ্টতা থাকলে শাস্তি নিশ্চিত করা কষ্টকর হয়ে যায়। তাই অস্পষ্টতা দূর করতে আইনটি দ্রুত সংশোধন জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘যদি সড়ক পরিবহন আইনের সব অপরাধ আমলযোগ্যই হয়, তাহলে প্রতিদিনই মামলার সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত হবে।’ এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইনে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। এ অস্পষ্টতা দূর করতে আমরা বসেছিলাম। কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে সংশোধন করে দিয়েছি। সংশোধনের সব প্রক্রিয়া শেষে সংসদে যাবে। সেখানে পাস হলেই সংশোধিত সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হবে।’

সর্বশেষ খবর