শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

এমআরদের আগ্রাসী প্রচারণায় রোগীর পেটে ওষুধের বোঝা

শামীম আহমেদ

ওষুধের অনৈতিক ও আগ্রাসী প্রচারণার বলি হচ্ছেন রোগীরা। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির লোভনীয় উপহারে নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছেন অনেক চিকিৎসক। তার প্রভাব পড়ছে রোগীর প্রেসক্রিপশনে। রোগ সারানো নয়, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের খুশি করতে ওষুধ লিখছেন তারা। প্রয়োজন না হলেও প্রেসক্রিপশনের পাতা ভরে লিখছেন দামি দামি নানা ওষুধ। এতে শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছেন রোগীরা। গত ৩ নভেম্বর সকাল ১০টা। মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট তখন রোগীতে ঠাসা। হাসপাতালের ভিতরে ও বাইরের ফার্মেসিগুলোর সামনে স্যুটেড-ব্যুটেড হয়ে মোবাইলের ক্যামেরা চালু করে প্রস্তুত বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি (এমআর)। কোনো রোগী চিকিৎসকের চেম্বার থেকে বের হলেই ঘিরে ধরছেন তারা। ছবি তুলছেন প্রেসক্রিপশনের। অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী চিকিৎসক সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখেছেন কি না সেটা যাচাইয়ের জন্যই এই ছবি-শিকার। ওষুধ না লিখলে বাতিল বিদেশ ভ্রমণ বা লোভনীয় নানা উপঢৌকন বরাদ্দ। মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের এই আগ্রাসী প্রচারণা প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকের চেম্বারে। যে হাসপাতালে রোগী বেশি, সেখানেই ভিড় বেশি এমআরদের। ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাধ্যমে কয়েকজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্দিষ্ট এলাকা বা হাসপাতালকেন্দ্রিক ওষুধ বিক্রির একটা লক্ষ্যমাত্রা থাকে তাদের। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে হুমকিতে পড়ে চাকরি ও ইনসেন্টিভ। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করলে রাতারাতি উন্নতি। তাই প্রয়োজনীয়তা নয়, রোগীকে ওষুধ খাওয়াতে হবে- এই লক্ষ্য নিয়েই মূলত কাজ করেন তারা। যে কোনো প্রলোভনে নিজের কোম্পানির ওষুধটা গছাতে তারা চিকিৎসকদের নানা প্রস্তাব দেন। আগে প্যাড, কলম, কলমদানি, ঘড়ি, ওষুধের স্যাম্পল উপহার হিসেবে দেওয়া হলেও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে সেটা বদলে গেছে নগদ প্রণোদনা, বিদেশ ভ্রমণ, ফার্নিচার, ইলেকট্র্রনিক্স পণ্য, ওষুধ বিক্রির ওপর নগদ কমিশনে। এ ছাড়া বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামেও ওষুধ কোম্পানিগুলো স্পন্সর করছে। সেমিনারের বক্তাদের দেওয়া হচ্ছে বড় অঙ্কের সম্মানী। সম্মানী নেওয়া চিকিৎসকরা দায়বদ্ধতা থেকেই ওই কোম্পানির ওষুধ লিখছেন। এদিকে দামি উপহার দেওয়া একাধিক কোম্পানিকে সন্তুষ্ট করতে রোগীর প্রেসক্রিপশনের পুরো পাতা ভরে উঠছে দরকারি-অদরকারি নানা ওষুধে। এমনকি হৃদরোগীদের দেহে রিং, পেসমেকার, ভাল্ব, অর্থোপেডিক রোগীদের হাত, পা, হাঁটু ও মেরুদন্ডের রড, প্লেটসহ নানা রকম চিকিৎসা-সরঞ্জাম লাগানোর ক্ষেত্রেও রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। অনেক চিকিৎসক এটার নাম দিয়েছেন লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা। যে ওষুধ লেখা বা চিকিৎসা সরঞ্জাম লাগানোর সঙ্গে চিকিৎসকের লাভ-লোকসান জড়িত, তা কতটুকু কাজে আসবে সেই প্রশ্ন খোদ রোগীদেরই। ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের পাঁচজন চিকিৎসক এক গবেষণায় দেখতে পান, কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের ভালো অঙ্কের অর্থ, ভ্রমণ ভাতা, কর্মশালায় স্পন্সরশিপ, চেম্বার ডেকোরেশন, ওষুধের স্যাম্পল এবং হরেক রকম উপহার দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ভূমিকার ওপর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ইন রিসার্চ ট্রেন্ড- এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ ভাগ ওষুধ কোম্পানি ৭০ ভাগ মার্কেট শেয়ার দখল করে আছে। ওষুধ বিক্রি বাড়াতে কোম্পানিগুলো আগ্রাসী মার্কেটিং কৌশল গ্রহণ করছে। অধিক মুনাফার জন্য মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের মাধ্যমে সব নীতি ভঙ্গ করে অনৈতিকভাবে ওষুধের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। চিকিৎসকদের দিয়ে অনুপযুক্ত প্রেসক্রিপশন লেখাতে ভূমিকা রাখছেন এমআররা। এমআরদের থেকে অনৈতিক প্রস্তাব পেয়ে চিকিৎসকরা অসচেতনভাবে প্রেসক্রিপশন লিখছেন, যা দিনকে দিন চিকিৎসা ব্যয় বাড়াচ্ছে এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে। এ ছাড়া ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকগুলো অকার্যকর হয়ে যাবে। নতুন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন পড়বে। চিকিৎসা খরচ আরও বাড়বে। উন্নত ভবিষ্যতের জন্য রোগীকে নিজের আত্মীয় মনে করে চিকিৎসা, জেনেভা ঘোষণা বাস্তবায়ন ও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের নীতিমালা অনুযায়ী সচেতনভাবে প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য চিকিৎসকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ওই গবেষণায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের দায়িত্বও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন কোনো ওষুধ বাজারে এলে সেটা সম্পর্কে চিকিৎসকদের জানানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে এ জন্য সপ্তাহে এক দিন চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করে লিফলেট দেওয়াই যথেষ্ট। প্রয়োজন না থাকলেও প্রলোভন দেখিয়ে কোনো ওষুধ লিখতে বাধ্য করা অপরাধ। ওষুধের আগ্রাসী বিপণন বন্ধে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের বিধিমালায় স্পষ্ট করে বলা আছে- ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের প্রচারণায় চিকিৎসকদের কোনো ধরনের উপহার, প্রণোদনা বা সহযোগিতা দিতে পারবে না। তবে সেই নির্দেশনা মানছেন না ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। তারা চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে নানা রকম উপহার, বিদেশ ভ্রমণ, প্রণোদনা, এমনকি কমিশনের প্রস্তাব দেন। সব চিকিৎসক এসব অনৈতিক প্রস্তাব মেনে নেন না। তবে অনেকেই বাধ্য হয়ে বা লোভে পড়ে প্রস্তাব মেনে নেন। এদিকে প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলায় ভঙ্গ হচ্ছে রোগীর রোগের গোপনীয়তা। অনেক সময় গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে উদ্বিঘ্ন স্বজন এমআরদের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। বিভিন্ন জেলায় সিভিল সার্জন অফিস থেকে রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও তা মানছেন না কেউ। এ নিয়ে রোগীদের সঙ্গে বাগবিতন্ডাও হচ্ছে এমআরদের। কিছু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের সঙ্গে এমআরদের সাক্ষাতের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিলেও তারা তা মানছেন না। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম। অসুস্থ শরীরে চিকিৎসকের চেম্বারের বাইরে রোগীর অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হচ্ছে। গত জুনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিয়ম ভেঙে প্রবেশ ও রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের ছবি তোলায় কয়েকজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভকে বেঁধে রাখার ঘটনাও ঘটেছে।

অভিযোগ দেশে দেশে : করোনাকালে ভারতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ওষুধ প্যারাসিটামল গ্রুপের ‘ডোলো-৬৫০’। আর এই ওষুধটির বিক্রি বাড়াতে চিকিৎসকদের পেছনে ঘুষ হিসেবে ১ হাজার কোটি টাকা খরচের অভিযোগ উঠেছে দেশটির একটি বড় ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে। গত আগস্টে অভিযোগটি আদালতে ওঠার পর ফার্মাগুলোর ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ। উচ্চতর কমিটি গঠন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মাত্রাতিরিক্ত অপিওয়েড (নেশাজাতীয় ব্যথানাশক) সেবনে হাজারো মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের অক্টোবরে এটাকে ‘জাতীয় সংকট’ ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ঘোষণার দিনই গ্রেফতার হন দেশটির বড় ওষুধ কোম্পানি ইনসিস থেরাপিউটিকসের প্রতিষ্ঠাতা জন কাপুর। ২০১৯ সালে তিনি অপিওয়েড সংক্রান্ত মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন। তার বিরুদ্ধে প্রয়োজন না হলেও নেশাজাতীয় ব্যথানাশক প্রেসক্রাইব করতে চিকিৎসকদের ঘুষ প্রদানের প্রমাণ মেলে। ২০১৩ সালে চীনে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের (মংশ) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওষুধ বিক্রি বাড়াতে চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। খোদ চীনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি জানায়।

সর্বশেষ খবর