বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

লাশের ডাম্পিং জোন নদী!

দুই বছরে মিলেছে ৬৭৫ লাশ ♦ ৪৯৫টি শনাক্ত ১৮০টি অজ্ঞাত অবস্থায় দাফন ♦ হত্যা মামলা ৭৭ অপমৃত্যু ২৮৫

সাখাওয়াত কাওসার

লাশের ডাম্পিং জোন নদী!

ফারদিনের বাবার আহাজারি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

খুন করে লাশ ফেলার নিরাপদ ডাম্পিং জোন হয়ে উঠেছে নদী। আলামত গায়েব করে অপরাধীরা নিজেদের আড়াল করার জন্যই লাশ গায়েব করার জন্য বেছে নিচ্ছে নদীকে। গত এক সপ্তাহে কেবল নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতেই দুটি লাশ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ সোমবার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের পেছনে নদী থেকে বুয়েটছাত্র ফারদীন নূর পরশের লাশটি অর্ধগলিত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদী ও নদীর পাড়ঘেঁষা সড়কে নজরদারির অভাব থাকায় বারবার এমন দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কথা বলছেন তারা। নৌপুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নদীপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আসলে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করছি। নৌপথে প্যাট্রল আগের তুলনায় অনেক বাড়ানো হয়েছে। ফলে নৌপথের অপরাধ আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। তবে নদ-নদীর পুরো অংশই তো আমাদের সার্ভিলেন্সে রাখা সম্ভব নয়। নৌপথে কিংবা নদীতে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে আমাদের অবহিত করতে পুলিশের অন্যান্য ইউনিটকে নির্দেশনা দেওয়া আছে।’ নৌপুলিশের তথ্য বলছে, গত বছর থেকে চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত দুই বছরে নদী থেকে ৬৭৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়। ৪৯৫টি লাশ শনাক্ত হয়েছে। ১৮০টি অশনাক্ত অবস্থায় দাফন করা হয়েছে। লাশ উদ্ধারের এসব ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে ৭৭টি। আর ২৮৫টি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। ৩১৩টি লাশ বিনা ময়নাতদন্তে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে ৩১৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৬২টি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। হত্যা মামলা হয়েছে ৪১টি। এখনো ৯২টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলা নিয়ে নৌপুলিশের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের তথ্য বলছে, এ অঞ্চলে হত্যা, চুরি, দস্যুতা ও ডাকাতির ১২২টি মামলা তদন্তাধীন আছে। এর মধ্যে ২৪টি হত্যা মামলা এবং ২০টি অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে মামলা। তবে তদন্তের অগ্রগতি হলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলাগুলো খুনের মামলায় টার্ন নিতে পারে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মিনা মাহমুদা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনা দেশে-বিদেশে বহুল আলোচিত হয়। এর আগে ২০১৩ সালের ৮ মার্চ মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টিও সাধারণ মানুষের মনে দাগ কাটে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুল-কলেজে এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়। তবে পরিচয় শনাক্ত না হওয়ার কারণে নদী থেকে উদ্ধার লাশের বেশির ভাগই বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে অপমৃত্যু মামলা হয়। অপমৃত্যু  মামলার তদন্তে পুলিশও ততটা গুরুত্ব দেয় না। অনেক সময় লাশ গলে বা পচে গেলে পরিচয় শনাক্ত করা যায় না। পরিচয় শনাক্ত করতে না পারলে আসামি গ্রেফতার করাও সম্ভব নয়। এক এলাকার লাশ ভেসে ওঠে অন্য এলাকায়, এ কারণে পরিচয় শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ডিএনএ নমুনা নিয়ে নিখোঁজ পরিবারের অভিযোগের সূত্র ধরে পরিচয় জানার চেষ্টা করা হয়। ২১ জুন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় স্বর্ণামতী নদীর ব্রিজের নিচ থেকে ভেসে আসা অজ্ঞাত এক পুরুষের (৪০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে লাশটি দাফন করা হয়। গতকাল এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আদিতমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোক্তারুল ইসলাম বলেন, ‘লাশের ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে নমুনা পাঠানো হয়েছে ভিসেরা প্রতিবেদনের জন্য। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি।’ মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে নদী এবং নদীতীরবর্তী অঞ্চলের অপরাধ পয়েন্টগুলোকে সার্ভিলেন্সের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। এ জন্য নৌপুলিশের পাশাপাশি টুরিস্ট পুলিশ ও কোস্টগার্ড বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। অপরাধীরা নিজেদের আড়ালে রাখতেই নদী ও বনাঞ্চল বেছে নেয়। নদীতে বিশেষ করে লাশ স্রোতে ভেসে অন্যত্র চলে যায়। লাশ পচে বিকৃত হয়ে যায় এবং আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে। ১ মে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তিস্তা নদী থেকে খুশি খাতুন (১৪) ও হাসি খাতুন (১২) নামে দুই সহোদরার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। খুশি ও হাসি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কানি চরিতাবাড়ী গ্রামের হামিদুল ইসলামের মেয়ে। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটি হত্যাকান্ড বলে ধারণা করলেও গতকাল পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি আসেনি। এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি সরকার ইফতেখারুল মোকাদ্দেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘লাশ দুটির ময়নাতদন্তে হত্যার কারণ চিহ্নিত হয়নি। মেয়েদের মা-বাবা ডিভোর্সড। ইতোমধ্যে মা অন্যত্র পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছেন এটা আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে মামলাটির তদন্ত পিবিআইর কাছে চলে যাবে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ ২৬ মে নেত্রকোনার মগড়া নদী থেকে মস্তকবিহীন এক নারীর লাশ উদ্ধার করে মডেল পুলিশ। এ ঘটনায় এখনো আসামি গ্রেফতার তো দূরের কথা, নিহত নারীর পরিচয়ই শনাক্ত করা যায়নি। নেত্রকোনা মডেল থানার ওসি খন্দকার শাকের আহমেদ জানান, লাশটি কিছুটা গলিত থাকার কারণে পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। এ ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়া গেলে অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হবে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা আলোচিত ঘটনা ছাড়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেতে সাধারণত বছর লেগে যায়। এত সময় অতিবাহিত হওয়ার কারণে হত্যাকান্ডের পারিপার্শ্বিক আলামতও অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। পরে পুলিশ এসব ক্ষেত্রে তদন্ত করে ‘ফাইনাল রিপোর্ট ট্রুথ (এফআরটি)’ বা ‘ঘটনা সত্য কিন্তু আসামিদের শনাক্ত করা যায়নি’ লিখে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর