শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
বিশেষজ্ঞ অভিমত

আইএমএফের ঋণ সংকটের সাময়িক সমাধান

মানিক মুনতাসির

চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। এ ঋণের অর্থ পেলে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট, ডলার সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। বরং আইএমএফের এ ঋণ চলমান সংকটের সাময়িক সমাধান বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বৈশ্বিক এ সংকট সামাল দিতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যখন ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল, তখন আমরা এক ধরনের আত্ম-অহমিকায় ভুগছিলাম। তখন আমরা আত্মপ্রচারও করেছি। অথচ উচিত ছিল সে সময়টায় আমাদের আর্থিক খাতের সংস্কারমূলক কাজগুলোয় মনোযোগী হওয়া।’ তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বিরাট সুযোগ। এ ঋণের অর্থ পেলে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট, ডলার সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। বরং আইএমএফের এ ঋণ চলমান সংকটের সাময়িক সমাধান বলে মনে করেন তিনি। তবে বৈশ্বিক এ সংকট সামাল দিতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে হবে। এ দুইয়ের জন্য বৈদেশিক শ্রমবাজারের উন্নয়ন ও রপ্তানি বাজারের সম্প্রসারণ করতে হবে।

গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আইএমএফ আমাদের যেসব সংস্কারমূলক কাজের কথা বলেছে, সেগুলো কিন্তু আরও আগেই করা উচিত ছিল। এই ধরুন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করা। হুন্ডি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া। কিন্তু আইএমএফ আমাদের যেসব কাজের কথা বলেছে সেগুলো ঠিকঠাক করতে না পারলে ঋণ বন্ধও করে দিতে পারে। যেমনটি শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে হয়েছে। এ ছাড়া কোন কাজটা কীভাবে করছি, সংস্কারগুলো করছি কি না- আইএমএফ কিন্তু তা মনিটরিং করবে। এতে ত্রুটি পেলে তারা কিন্তু ঋণের কিস্তিও আটকে দিতে পারে। আমি তো মনে করি এ টাকাকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে তাদের সংস্কারমূলক শর্তগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তারা তো আগে থেকেই বলে আসছিল খেলাপি ঋণ কমাও। দুর্নীতি-অনিয়ম কমাও। ঋণ দিতে আরও সতর্ক হও। সুদহার বাড়াও। অর্থ পাচার ঠেকাও। এসব কিন্তু আমরা তখন শুনিনি। করিওনি। কারণ আমরা ভেবেছিলাম তাদের বলার কাজ বলুক। আমাদের মধ্যে তখন অহমিকাবোধ কাজ করছিল। সেটা খুবই ভয়ানক ক্ষতি করেছে। এখন কিন্তু সেগুলো সাদরে গ্রহণ করে বলছি, এসব আমরা আগে থেকেই করছি। কারণ এখন তো তাদের টাকাটা আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু এখানে টাকার চেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো সংস্কারগুলো।’

তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে- একটা রিউমার ছড়িয়ে গেছে যে কয়েকটা ব্যাংক বসে যাবে। মানুষ আতঙ্কিত। টাকা তুলে নিচ্ছে। এটা হয়েছে আমাদের জন্যই। কারণ আমরা খুবই বেশি আত্মপ্রচার করেছি। আমরা অনেক ওপরে চলে গেছি। আমাদের সন্তুষ্টিটা অনেক বেশি ছিল তখন আমরা কোনো কাজই করিনি। ফলে এখন আমাদের এ সংকটটা এসেছে। যদিও এখানে বৈশ্বিক একটা ব্যাপার আছে।’

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আইএমএফের এ ঋণ তো কোনো ব্লাঙ্ক চেক নয়। নিশ্চয়ই এটার বিপরীতে কিছু শর্তও আছে। আমরা যতই বলি সব আমাদের দেওয়া, তা তো হতে পারে না। ওদের কিছু চাহিদা তো থাকবেই। সরকার যে বলছে, আইএমএফ কোনো শর্ত দেয়নি, সবই আমাদের দেওয়া। এগুলো আমরা আগে থেকেই করছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, প্রতিটা কিস্তি পাওয়ার আগে আমার তো কিছু কাজ করতে হবে। নাকি কিছুই করতে হবে না। এটা নিশ্চয়ই ব্লাঙ্ক চেক হতে পারে না। ওরা যে বলেছে আমরা এখানে কিছু দুর্বলতা দেখেছি। সেগুলো ওভারকাম করতে কিছু পরামর্শ দিয়েছি। সেগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। প্রতিটি কিস্তি পাওয়ার আগে কী কী করতে হবে, এগুলোর ব্রড এরিয়াগুলো আইএমএফ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেও। সেগুলা হলো পলিসি আউটকামের মতো। কিন্তু এর বাইরে তো অবশ্যই কিছু আছে, যা হয়তো উভয় পক্ষই প্রকাশ্যে বলছে না। আসলেই তাদের মধ্যে কোন কোন পলিসি বদলাতে হবে, আরও কী কী করতে হবে নিশ্চয়ই দুই পক্ষে এমন কিছু সমঝোতা হয়েছে। সেগুলো আগে জানতে হবে।’

জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এখানে একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো এ অর্থটা আমাদের সংকট মোকাবিলায় অনেকটা কাজে দেবে। তবে এটার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে। আর এটার সুযোগে আমাদের আর্থিক খাতের সংস্কারগুলো করতে হবে। যেমন আমানত ও ঋণের সুদহারের বিতর্কের অবসান ঘটানো। ভ্যাট আইন, ২০১২-এর পূর্ণ বাস্তবায়ন। একটা আইন আজ থেকে ১০ বছর আগে হয়েছে যা এখনো বাস্তবায়ন করতে পারছি না। কেন পারছি না। রাজস্ব বাড়ানো, করদাতা বাড়ানো, খেলাপি ঋণ কমানো, পাচার রোধ, হুন্ডি কমিয়ে আনা ইত্যাদি- এ কাজগুলো করতে পারলে কিন্তু আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা কেটে যাবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে।

সর্বশেষ খবর