শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
বুয়েট ছাত্র ফারদিন হত্যা

যেসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বুয়েট ছাত্র ফারদিনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর এখনো মিলছে না। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরাও সেসব প্রশ্ন ঘিরে রহস্যের জালে আটকে আছেন। তবে তারা উত্তর বের করার চেষ্টা করছেন। গত কয়েক দিনের তদন্তে প্রযুক্তিগত এবং সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ফারদিনের সর্বশেষ অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছেন তারা। তবে তার অবস্থান নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়ায় পাওয়া যায়নি। বরং ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু পার হয়ে রূপগঞ্জের বিশ্বরোড তারাবো এলাকায় অবস্থান দেখা গেছে। তদন্তে এসব তথ্য পাওয়ার পর কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তা হলো- পরীক্ষার কথা বলে বুয়েটের হলে বন্ধুদের সঙ্গে অবস্থান করবেন বলে আগের দিন বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন ফারদিন। তাহলে পরীক্ষার আগের রাতে বুশরার সঙ্গে ঘুরে বেড়ালেন কেন? এরপর কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকায় গেলেন কেন? সেখান থেকে জনসন রোড হয়ে গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ীতে এত রাতে কী করছিলেন? আবার যাত্রাবাড়ী থেকে তার বাসা কোনাপাড়ার দিকে যাওয়ার লেগুনায় উঠে কোথায় যেতে চেয়েছিলেন? শুধু তদন্ত কর্মকর্তারাই নন, ফারদিনের বাবাও এসব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারেননি। তবে ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্ট হাতে পেলে কিছু হিসাব মেলাতে পারবেন এমনটাই বলেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ফারদিনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ১০ নভেম্বর রামপুরা থানায় তার বাবার করা মামলায় একমাত্র আসামি আমাতুল্লাহ বুশরা নামে এক বন্ধবীকে রিমান্ডের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একই থানায় ৫ নভেম্বর ছেলে নিখোঁজের ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা। ঘটনার আগে ফারদিনের অবস্থান এবং সিসিটিভির ফুটেজ নিয়ে তার বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানার সঙ্গে গতকাল দুপুরে কথা বলেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগের কর্মকর্তারা। এর আগে বেলা ১২টায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘৪ নভেম্বর অর্থাৎ ফারদিন যেদিন থেকে নিখোঁজ ছিলেন, ওই দিন রাত সোয়া ২টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মোড়ে একটি লেগুনায় উঠতে দেখা গেছে তাকে। সাদা গেঞ্জি পরিহিত এক যুবক তাকে একটি লেগুনায় তুলে দিচ্ছে। ওই লেগুনায় আরও চারজন ছিল। পরে লেগুনাটি তারাবোর দিকে চলে যায়। লেগুনার চালক ও সহযোগীদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তার মৃত্যুর কারণ এখনো জানা যায়নি। কোথায় তাকে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত কিছু পাওয়া যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজে যে সময়ে ফারদিনের অবস্থান যাত্রাবাড়ীতে দেখা গেছে, ঠিক একই সময়ে তার চনপাড়ায় থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার সর্বশেষ অবস্থান ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু পার হয়ে রূপগঞ্জের বিশ্বরোড তারাবো এলাকায় পাওয়া গেছে। আশা করি শিগগিরই এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটিত হবে।’ প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ধানমন্ডির ইয়াম চা ডিস্ট্রিক্ট রেস্টুরেন্টে ফারদিন ও বুশরা একসঙ্গে বসছিলেন। এরপর তারা নিউমার্কেটে যান একটি বই কিনতে। সেখান থেকে দুজন টিএসসিতে গিয়ে কিছু সময় কাটিয়েছেন। এরপর ফারদিন রিকশায় বুশরাকে নিয়ে রামপুরা ব্রিজে আসেন রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে। এখানে বুশরাকে নামিয়ে দিয়ে ঢাকার কেরাণীগঞ্জের জিঞ্জিরায় ফারদিনের অবস্থান দেখা গেছে রাত ১০টা ৫৩ মিনিটে। সেখান থেকে জনসন রোডে এসে অবস্থান দেখা গেছে রাত ১১টা ৯ মিনিটে। এ সময় বুশরা তাকে একটি মেসেজ করেন- Are you got home? অর্থাৎ তুমি কি বাসায়?। উত্তরে ফারদিন লিখেন,yeap অর্থাৎ হ্যাঁ। রাত ১২টা ৫০ মিনিটে ফারদিনের অবস্থান দেখা যায় গুলিস্তান পাতাল মার্কেট এলাকায়। এরপর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় রাত ১টা ৫৯ মিনিটে অবস্থান দেখা গেছে তার। এ সময় এক বান্ধবীর সঙ্গে ফারদিনের কথোপকথনের তথ্য পাওয়া যায়। যাত্রবাড়ী থেকে লেগুনায় ওঠার পর সুলতানা কামাল সেতু পার হয়ে তারাবো বিশ্বরোডে তার অবস্থান দেখা গেছে রাত ২টা ৪০ মিনিটে। এসব তথ্য পাওয়া গেছে ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে।

 

এসব বিষয়ে ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘ফারদিন কোনো মানসিক সমস্যায় ছিলেন কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি কেনই-বা রামপুরা থেকে কেরানীগঞ্জ গেলেন, এরপর জনসন রোড, গুলিস্তান, তারপর যাত্রাবাড়ীতে এলেন। যদি বাসায় যেতেন, তাহলে যাত্রাবাড়ী থেকে লেগুনায় উঠে যাওয়ার পথে তার কোনাপাড়ায় নামার কথা ছিল। তা না করে তারাবো এলাকায় কেন গেলেন। এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা খোঁজার চেষ্টা করছি।’

তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে লেগুনায় উঠে যাত্রীদের তিনজন বিশ্বরোডে গিয়ে নামেন। একজন এর পরের স্টপেজে নামেন। ওই জায়গা থেকে চনপাড়া যেতে অন্তত এক ঘণ্টা লাগার কথা। ফলে রাত আড়াইটার দিকে ফারদিনের যে চনপাড়ায় উপস্থিতির কথা বলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়।

এর আগে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, ফারদিন রাত আড়াইটার দিকে চনপাড়া বস্তিতে ছিলেন। তাকে ওই বস্তির রায়হান গ্যাং হত্যা করে থাকতে পারে। তারা রায়হান ও তার সহযোগীদের নজরদারিতে রেখেছে।

গতকাল দুপুরে ডিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা বলেন, ‘কয়েকটি স্থানে ফারদিনের চলাফেরার তথ্য নিয়ে ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এটি আমরাও বুঝতে পারছি না কেন সে এসব এলাকায় গেল, কী কারণে। তবে তারা নিশ্চিত হয়েছেন ফারদিন চনপাড়ায় যায়নি। আমার ছেলে সিগারেটের গন্ধও সহ্য করতে পারে না। অথচ যারা বলল সে মাদক কিনতে চনপাড়ায় গেছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত। এসব প্রচার করে ছেলে হারানোর পর আমার হৃদয়ে আবারও আঘাত করা হয়েছে।’

তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, চনপাড়ায় ফারদিনের লাশ একটি প্রাইভেট কারে তুলে ফেলার যে কথা বলা হচ্ছে, তাও সঠিক নয়। কারণ রাত সোয়া ২টার দিকে ফারদিনের অবস্থান যাত্রাবাড়ীতে ছিল। আর ওই গাড়ির মুভমেন্ট ছিল রাত দেড়টার সময়।

শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় ফারদিনের লাশটি উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ নৌ সদর থানা পুলিশ। নৌ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান জানান, ৯৯৯-এ খবর পেয়ে তারা লাশটি উদ্ধার করেন। তবে লাশে কোনো বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন পাননি। লাশ পচে যাওয়ায় তা চেনারও উপায় ছিল না। তার ফিঙ্গারপ্রিন্টও নেওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে লাশে পাওয়া বন্ধ মোবাইল থেকে সিম খুলে অন্য মোবাইলে সংযুক্ত করলে তার স্বজনরা ফোন দেন। এরপর পরনের পোশাক, হাতঘড়ি ও বেসলেট দেখে তারা লাশ শনাক্ত করেন।

জানা গেছে, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে প্রায় তিন বছর ধরে বুশরার সঙ্গে ফারদিনের পরিচয়। তবে তাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক বন্ধুত্বের। বুশরার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। তিনি রাজধানীর বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। ফারদিন হত্যায় তার সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য তদন্ত কর্মকর্তারা এখনো পর্যন্ত পাননি।

সর্বশেষ খবর