মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

আগেই সতর্ক করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

আদালতপাড়া থেকে পলাতক দুই জঙ্গি নজরদারিতে : ডিবি

উবায়দুল্লাহ বাদল

আগেই সতর্ক করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

পুলিশের চোখে স্প্রে ছুড়ে রাজধানীর আদালতপাড়া থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরই দেশে জারি করা হয় রেড অ্যালার্ট। অথচ ঘটনার প্রায় এক মাস আগে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় পুলিশি নজরদারি আরও বাড়াতে অনুরোধ করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। কারণ হিসেবে তারা বলেছিল, কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা ওই সময় বন্দিদের মাদক, মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন অবৈধ দ্রব্য দিয়ে থাকেন। বন্দিদের নিরাপত্তাও ওই সময় শিথিল থাকে। এ কারণে নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে পুলিশ অধিদফতরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে ২৫ অক্টোবর জননিরাপত্তা বিভাগে চিঠি দেয় সুরক্ষা সেবা বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়- দেশের কারাগারে আটক বন্দিদের কারা ফটক থেকে পুলিশি পাহারায় আদালতে নেওয়া হয়। আদালতের কার্যক্রম শেষে পুনরায় কারাগারে প্রত্যাবর্তনের সময়ে যাতে বন্দিরা মাদক, মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন অবৈধ দ্রব্য বহন করতে না পারে। এ লক্ষ্যে ওই সময়ে পুলিশি নজরদারি ও তল্লাশি কার্যক্রম জোরদার করার জন্য পুলিশ অধিদফতরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। এর আগেও কারাগারের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর সুরক্ষা সেবা বিভাগের তৎকালীন যুগ্মসচিব মুনিম হাসানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল কমিটি। ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- ‘কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নিয়মিতভাবে প্রিজনভ্যানে আসামিদের কোর্টে পাঠানো হয়। সাম্প্রতিককালে অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রিজনভ্যানে গমনকারী আসামিরা তাদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য কর্তব্যরত পুলিশ ৪/৫টি মোবাইল ফোন প্রিজনভ্যানে দেওয়া হয়। কারাগার থেকে আসামিদের কোর্টে প্রিজনভ্যানের মাধ্যমে আনা নেওয়ার কাজটি পুলিশ করে থাকে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, সুরক্ষা সেবা বিভাগের চিঠি পাওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটল; যা অনাকাক্সিক্ষত। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবে। এ ঘটনায় কাদের গাফিলতি ছিল তা তদন্তে উঠে আসবে নিশ্চয়। গতকালই বন্দি ছিনতাইয়ের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। এদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্তে গতকালই সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (কারা) নেতৃত্বে ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- পুলিশ মহাপরিদর্শকের একজন প্রতিনিধি (ডিআইজি পদমর্যাদা), কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। একইভাবে পুলিশ অধিদফতরও চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অডিট) মো. আমিনুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব হলেন অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম মেট্রো) মো. হাসানুজ্জামান। সদস্যরা হলেন- সিটিটিসির ড. এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মেট্রো সাউথ) মো. আনিচুর রহমান। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

আদালত চত্বরকেই নিরাপদ মনে করছিল জঙ্গিরা : আসামি ছিনতাইয়ের জন্য আদালত চত্বরকেই সবচেয়ে নিরাপদ মনে করেছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা। এ কারণে গত এক বছর ধরে চলছিল যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। সে অনুযায়ী ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে কেনা হয় অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতির হোন্ডা হরনেট মোটরসাইকেল। সবশেষ তিন মাস আগে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত রবিবারকেই টার্গেট করা হয়। সেজন্য আগে থেকেই আদালত চত্বরে অবস্থান নেয় ১৮ জঙ্গি। তাদের একজন পিপার স্প্রে ছুড়েন ও আরেকজন ছিলেন দড়ি কাটার দায়িত্বে। দুজন মোটসাইকেল নিয়ে স্ট্যান্ডবাই ছিলেন। রবিবার দুজন জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর বাকি ১০ জনকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ বলেছেন, যারা পালিয়েছেন এবং যারা সহযোগিতা করেছেন সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। তারা সবাই নজরদারিতে রয়েছেন।

সূত্র বলছে, আশিকুজ্জামান নামের ওই ভুয়া এনআইডি দিয়ে গত মে মাসে হোন্ডা হরনেট ১৬০ সিসি মোটরসাইকেলটি কেনা হয়। বিক্রয় ডট কম থেকে কেনা এই বাইকটি গত রবিবার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। পালানোর বিষয়ে বাইরে থাকা জঙ্গিরা নিয়মিত কারাগারের শীর্ষ জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছিল। এই যাত্রায় চারজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও দুজনের বিষয়ে সফলতা এসেছে। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, মেজর জিয়া  নেতৃত্ব দেননি। তবে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছেন তারা। একইসঙ্গে অপারেশনে অংশ নেওয়া কয়েকজনের নাম পেয়েছেন। যেসব আসামিকে আদালতে হাজিরার জন্য আনা হয়েছিল তারা সবাই আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখা অর্থাৎ আস্কারি বিভাগের সদস্য ছিলেন। তাদের সবাইকে সিটিটিসি ২০১৬ সালে গ্রেফতার করেছিল।

একাধিক সূত্র বলছে, ঘটনার দুই ঘণ্টার মধ্যেই সারা দেশে রেড অ্যালার্ট জারি করায় পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিরা সীমান্ত পার হওয়ার সাহস করবে না। সম্ভাব্য সব পয়েন্টের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ চলছে।

গতকাল র‌্যাব সদর দফতরে আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গির আগের অপরাধের ধরন, তাদের আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন সময়ে চলাফেরা সবকিছু পর্যালোচনা করছে র‌্যাব। ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও তাদের সহযোগীদের ধরতে র‌্যাবের সব ইউনিট কাজ করছে। আদালত প্রাঙ্গণ, অন্যান্য জায়গা, সিসিটিভি ফুটেজ এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে তারা। পাশাপাশি গোয়েন্দা কার্যক্রম চলছে। ডিবি বলছে, ছিনিয়ে নেওয়া দুজন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য। তারা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এই জঙ্গি সংগঠনের নেতা মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক। যার পরিকল্পনায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একাধিক লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও সমকামী অধিকারকর্মীকে হত্যা করা হয়।

উল্লেখ্য, রবিবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল থেকে আট জঙ্গিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। তারা যখন সিএমএম আদালতের প্রধান ফটকের সামনে আসেন, তখন হাতকড়া পরা দুই জঙ্গি তাদের নিরাপত্তায় থাকা পুলিশের এক সদস্যকে মারধর শুরু করেন। মুহূর্তের মধ্যে আশপাশে থাকা জঙ্গিদের সহযোগীরাও পুলিশের ওপর হামলায় যোগ দেন। পুলিশের ওই সদস্যকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তাদের ওপর হামলা এবং স্প্রে ছিটিয়ে সিএমএম আদালতের প্রধান ফটকের উল্টো দিকের গলি দিয়ে মোটরসাইকেলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেন সহযোগীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর