শিরোনাম
বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়ে উৎকণ্ঠা

সাখাওয়াত কাওসার

জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়ে উৎকণ্ঠা

জামিনে মুক্ত জঙ্গি সদস্যদের নিয়েই আতঙ্কে ভুগছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। কারণ এদের অনেকেই জামিন নিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। আত্মগোপনে থেকেই সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে খবর পাচ্ছেন গোয়েন্দারা। তারা বলছেন, গত চার বছরে সবগুলো নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের ৬১০ জন জামিনে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আনসার আল ইসলামের ৬৬ জন। আবার এই ৬৬ জনের মধ্যে ৩০ জন আত্মগোপনে রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-এবিটি) এই আতঙ্কের মধ্যেই গোয়েন্দাদের মাথাব্যথার কারণ হিসেবে যুক্ত হয়েছে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় দুর্গম পাহাড়ে থাকাবস্থায়ই তাদের বিষয়ে খোঁজ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যে এই সংগঠনের ২৯ জনকে গ্রেফতার করেছে এলিট ফোর্স র‌্যাব। এরই মধ্যে ১৯ জেলার ৫৫ জন তরুণ নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। অপরাধ দমনে পুলিশের বিশেষায়িত অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট সূত্র বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চার বছরে ৬১০ জন জঙ্গি জামিনে মুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) জঙ্গি ৬৬ জন। ওই সময় ৩০ জন জঙ্গি সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে। গত ২ বছরে এবিটির ৪৫ জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ২০০১ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত এবিটির বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১৪৪ এবং মোট আসামি ৫৮২ জন।

মানবাধিকারকর্মী আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জামিন তো সবার অধিকার। আবার অনেক সময় দেখা যায় দুর্বল চার্জশিটের কারণে অনেকেই এর সুযোগ নিচ্ছে। তবে কোনো দুর্ধর্ষ আসামি জামিনে এলেও পুলিশের উচিত তাকে নজরদারিতে রাখা। এ ক্ষেত্রে পুলিশ কি তা করছে? নাকি নিজেদের পোস্টিং ও প্রমোশন নিয়ে সময় পার করছে?

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে জঙ্গির সংখ্যা ৫ হাজার ৩১৮ জন। গত ১৭ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ৩৪২টি মামলা হয়েছে। মূলত ওই সব মামলার আসামি থেকে পুলিশ জঙ্গির সংখ্যা নির্ধারণ করেছে। এদের মধ্যে জামিনে আছে ২ হাজার ৫১২ ও জেল হাজতে আছে ১ হাজার ৭২৫ জন। মোট গ্রেফতার হয়েছিল ৫ হাজার ২৭ জন। র‌্যাব সদর দফতর সূত্র বলছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত ২ হাজার ৮৭১ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৩৫১ জন, ২০২১ সালে ২৯৬ জন এবং চলতি বছর ১৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে আনসার আল ইসলামের ৪৩৫ জন এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৯৭ জন। আভিযোগ রয়েছে, জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অনেকেই আবার উগ্রবাদী কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি জামিন নিয়ে আবারও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে কিছু সংখ্যক জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জানা যায়, জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা দিচ্ছে না। এ জন্য তাদের ধরতে অনেকটা ইন্টারপোলের মতোই রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। একাধিক সূত্র বলছে, বিভিন্ন সময় জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছে ২৭২ জঙ্গি। তাদের সন্ধানে মাঠে নেমেছে পুলিশের একাধিক ইউনিট। ধারণা করা হচ্ছে, পরিচয় গোপন করে বেশির ভাগই দেশের ভিতর অবস্থান করছে। আবার কেউ দেশের বাইরেও পালিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে তাদের ধরতে পুলিশের ইউনিটগুলো রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। যেভাবেই হোক তাদের ধরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দফতর থেকে। এমনকি বিশ্বের সর্বোচ্চ পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ওই সব জঙ্গিকে শনাক্ত করে সতর্কতা জারি করতে অনুরোধ জানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করেন এমন কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে আনসার আল ইসলাম। আগে এই সংগঠনটির নাম ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)। ২০১৫ সালে এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তখন থেকে আনসার আল ইসলাম নামে কার্যক্রম চালায় এর সদস্যরা। পরে ২০১৭ সালে সরকার আনসার আল ইসলামকেও নিষিদ্ধ করে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের বিষয়ে আমরা খুবই সিরিয়াস। জামিনে থাকা জঙ্গিসহ দুর্ধর্ষ আসামিদের নজরদারির মধ্যে রাখতে ডিএমপির সদস্যদের সদা সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের অন্য ইউনিটগুলোর মতো আমরাও পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, জামিনে আসার পর নিয়মিত আদালতে হাজিরা না দেওয়া জঙ্গিদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপারদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে রবিবার ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার পর পরই নড়েচড়ে বসে পুলিশ সদর দফতর। এটিইউর উপমহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘রবিবারের ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়া ২ জঙ্গিকে ধরতে আমরা অফিসারদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছি। এ ছাড়া জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এটিইউ অনেক সফলতার প্রশংসাও পেয়েছে।’  সূত্র বলছে, কয়েক বছর ধরে জঙ্গিবাদ নিয়ে অনেকটা ঢিলেঢালা সময় পার করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। অনেকটাই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছিলেন অনেক কর্মকর্তা। তবে জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জঙ্গিরা লুট, ছিনতাই ও ডাকাতির মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করছে। এত দিন তাদের নেটওয়ার্ক উত্তরবঙ্গে থাকলেও বর্তমানে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিস্তৃত করেছে। করোনাকালেও অনলাইনে তারা সদস্য সংগ্রহ, বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তারা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে নতুন কর্মী সংগ্রহ, মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতে অনলাইন ব্যবহার করেছে। তবে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘র‌্যাব সব সময়ই জঙ্গিবাদ দমনে সিরিয়াস। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামের জঙ্গি সংগঠনের বিষয়ে র‌্যাবই প্রথম খোঁজ পায়। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অনেক সফলতাও দেশবাসী দেখেছে। তবে এই সংগঠনের নিখোঁজদের বিষয়ে আমরা বিরতিহীনভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’

সর্বশেষ খবর