সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা

১২ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে মুক্তিযোদ্ধারা। টাঙ্গাইলে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দিন-রাত যুদ্ধ শেষে ভোরে বিজয়কেতন ওড়ায় যৌথবাহিনী। ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক অবস্থানের ওপর অব্যাহত বিমান হামলা চলছে। পরাজয় আসন্ন বুঝে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা নেয় জান্তা সরকার। ঢাকা সেনানিবাসে প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সভাপতিত্বে বৈঠক বসে। বৈঠকে আলবদর, আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়। বৈঠক শেষে ফরমান আলী তৎকালীন বাংলাদেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তুলে দেন হন্তারক বাহিনীর হাতে। বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে সে রাতেই আলবদর বাহিনী সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে তাদের বাসভবন থেকে অপহরণ করে। তারা আর ফিরে আসেননি। এদিকে ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় কারফিউ অব্যাহত রেখে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় ঘরে ঘরে তল্লাশির নামে লুটতরাজ শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। অনেকে ঢাকা ছেড়ে মুক্তাঞ্চলে চলে যান। এদিন চার নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা দিনব্যাপী যুদ্ধে হরিপুরকে শত্রুমুক্ত করে। হানাদারমুক্ত হয় নীলফামারী, গাইবান্ধা, নরসিংদী, সরিষাবাড়ী, ভেড়ামারা, শ্রীপুরসহ অনেক এলাকা। দিনাজপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পিছু হটার এক পর্যায়ে বিরল থানার বহলা গ্রামের বাসিন্দাদের মাইকযোগে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেয়। সেখানে মাগরিবের আজানের সময় অনেকে নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে গেলে পাকিস্তানি সেনারা নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর ব্রাশফায়ার করে। শহীদ হন নিরীহ ৩৭ জন মানুষ। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ১২ ডিসেম্বর মধ্যাহ্নের আগেই ঢাকায় ভারতীয় বাহিনীকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এদিকে চীনের রাষ্ট্রীয় বেতার রেডিও পিকিং থেকে এক ঘোষণায় বলা হয়, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের মাধ্যমে পাকিস্তান আক্রমণ করে মূলত চীনকেই দমন করতে চায়। ভারতের মাধ্যমে তথাকথিত বাংলাদেশ সমর্থনের অন্যতম কারণ বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার। পূর্ব পাকিস্তানকে নিজেদের অধীনে রাখাই ভারতের একমাত্র লক্ষ্য। মূলত পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বিরোধিতার আন্দোলন ভারত সরকারের উসকানিতেই সৃষ্টি।’ প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর ম্যাকগভর্ন বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশে প্রবেশ করে ঠিক কাজই করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা বন্ধ করার জন্যই তারা সেখানে প্রবেশ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভারতকে দায়ী করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ ভুল।’ এদিন দিল্লির রামলীলা ময়দানে বিশাল জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘ভারত নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই পাকিস্তানের দুর্দশার জন্য দায়ী। কমিউনিজম ঠেকানোর নামে সামরিক সাহায্য দিয়ে এবং গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধে ইন্ধন জুগিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই পাকিস্তানের গোরস্থান রচনার পথ প্রশস্ত করেছে। কারণ এই সামরিক সাহায্যই পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকদের উদ্ধত এবং আপন জনগণের প্রতি উদাসীন করে তুলেছে।  ভেবেছে বুলেটের জোরেই তারা জনগণের গণতান্ত্রিক ভাবনাকে চিরদিন দমিয়ে রাখতে পারবে!’ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী বলেন, ‘একটি প্রাণ অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত আমরা পাকিস্তানের প্রতিটি ইঞ্চি ভূমির জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাব। পাকিস্তানের মাটি পাকিস্তানেরই থাকবে।’ ১২ ডিসেম্বর কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস কমিটির আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশ দিবস পালিত হয়। রাস্তায় রাস্তায় ফেস্টুন ও বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে জয় বাংলা স্লোগান ধ্বনিত হয়। বের হয় শোভাযাত্রা।

সর্বশেষ খবর