রবিবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্মার্ট বাংলাদেশের যত চ্যালেঞ্জ

মানিক মুনতাসির

ইতিহাসের বিরাট এক কালো অধ্যায় কাটিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পায় আওয়ামী লীগ। সে সময় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। এরপর ২০১৫ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার সময় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও ৮টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। টানা তৃতীয় মেয়াদের শেষ দিকে এসে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প উন্মুক্ত করা হয়েছে। সদ্য খুলে দেওয়া হয়েছে ঢাকাবাসীর স্বপ্নের প্রকল্প মেট্রোরেল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন এখন অনেকটাই বাস্তব। শত সংকট সত্ত্বেও পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল খুলেছে। চালুর অপেক্ষায় কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এসব প্রকল্পের সুফল নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

এদিকে ২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগও মনে করে অর্থনৈতিক সংকট, বৈশ্বিক সংকট, দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে চাঙা রাখা, চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ অব্যাহত রাখা, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির ওপর নির্ভর করছে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ভিত। ইতোমধ্যে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলমান বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও আগামী বছর উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার লক্ষ্যে সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপির টার্গেট ঠিক রেখে বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করলেও বাংলাদেশ তা ভালোভাবেই মোকাবিলায় করছে। যদিও দেশের অভ্যন্তরে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়েছে। কমে এসেছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। বৈশ্বিকভাবেই কর্মসংস্থানের চাকা স্থবির হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও চাহিদা বাড়িয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সরকার।

অর্থনীতির ধাক্কা সামলাতে চলতি বছরের বাজেটে জিডিপির টার্গেট কমিয়ে আনা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। চলতি বছরের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় অস্বস্তিদায়ক ছিল ডলার সংকট। যা এখনো চলমান। বৈশ্বিক সংকটের কারণে এই সংকট কবে কাটবে- তা কেউ বলতে পারছেন না। আবার সংকট কাটিয়ে আগামী বছর দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছে সরকার। এ জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে আগামী বছর সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপিই অর্জিত হবে বলে মনে করে অর্থ বিভাগ।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নতুন বছরটা হবে অনেক চ্যালেঞ্জের। যেহেতু এটা নির্বাচনের বছর-তাই রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও চাপ থাকবে। আবার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমও গতিশীল রাখতে হবে। কভিড যখন ধাক্কা দিয়েছিল তখন এতটা অর্থনৈতিক চাপ ছিল না। এখন সেটা বেড়েছে। এ জন্য ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদি সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে না পারি তাহলে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং ছিন্নমূল মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে। দেশের বেশির ভাগ মানুষই এসব কাতারে রয়েছে। রাজনীতি ও চলমান উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, রাজনৈতিক উন্নয়ন নিয়েও কথা বলা উচিত। কেননা আমাদের এখানে টেকসই রাজনৈতিক উন্নয়ন বলতে কিছু নেই। রাজনীতিকে টাকা কামানোর হাতিয়ার না করে জনকল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশই শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য টেকসই রাজনৈতিক উন্নয়নের পথ বেছে নিয়েছে, কিন্তু আমাদের এখানে সেটা গড়ে ওঠেনি।

আমাদের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করতে পারছি কি না-প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা জরুরি। ২০২০-২০২১ ছিল কভিডের ধাক্কার বছর। ২০২২ ছিল রিকোভারির বছর। কিন্তু রিকোভারিটা সেভাবে হয়নি। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। ২০২২ সালে দুটি বড় হোঁচট খেয়েছি। এর মধ্যে একটা হলো বৈশ্বিক। দ্বিতীয়টা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের। গত এক দশক আমরা মোটামুটি স্টেবল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সেটা যে টেকসই ছিল না তার প্রমাণটা আমরা পেয়ে গেলাম ২০২২-এ এসে। আসছে বছরটাতে এই অবস্থাকে স্টেবল আনাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে তিনি মনে করেন। 

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে আমরা চলে যাব। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য ৪টা ভিত্তি ঠিক করা হয়েছে। স্মার্ট সিটিজেন অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকটা সিটিজেন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে, স্মার্ট ইকোনমি অর্থাৎ ইকোনমির সব কার্যক্রম আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে করব ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট যেটা ইতোমধ্যে আমরা অনেকটা করে ফেলেছি, বাকিটাও করে ফেলব এবং আমাদের পুরো সমাজটাই হবে স্মার্ট সোসাইটি। তিনি আরও বলেন, ২০২১ থেকে ২০৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা তৈরি করে দিয়ে গেলাম। অর্থাৎ ’২১ থেকে ’৪১ কীভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে তার একটা কাঠামো প্রণয়ন করে সেটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য আমি রেখে যাচ্ছি।

আগামীর বাংলাদেশ কেমন হতে পারে তা মূল্যায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশে অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী জাপানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি বলেছেন, তার দেশ ঢাকাকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানের কথা বিবেচনা করবে। ২০২৩ সালে উভয় দেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫১তম বার্ষিকী উদযাপন করবে। ‘বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বন্ধু হিসেবে, বাংলাদেশ যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে আমরা সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সহযোগিতা ও সহায়তার বিষয় বিবেচনা করতে চাই। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং সরকার এ লক্ষ্য অর্জনে জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। জাপান বাংলাদেশের পাশেই রয়েছে।

এ ছাড়া মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে তার সক্ষমতা। জাতিসংঘের উচ্চতর কমিটি স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি শ্রেণি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে। ঢাকাবাসী ইতোমধ্যে মেট্রোরেলের চলাচল দেখছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম টানেল চালু হবে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। আসছে বছরটা একদিকে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে এই নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টির চ্যালেঞ্জও রয়েছে সরকারের সামনে। যার মাধ্যমে মূলত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ভিত গড়তে চায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।

 

সর্বশেষ খবর