রবিবার, ৩ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

ওদের মুখে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ওদের মুখে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা

কয়েকবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেছি। আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো ভবন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। পরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারিনি। যখন পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তখন সবাই ছোটাছুটি করছিলেন। তখন বন্ধুদের হারিয়ে ফেলি।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এসব কথা বলছিলেন মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদ মাহমুদ। তিনি বলেন, বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে চার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। আগুন লাগার পর ভবনের ছয় তলার একটি খাবারের দোকানের রান্নাঘরে ৬০/৭০ জন আশ্রয় নিয়েছিলাম। অনেকেই বের হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত ১০/১৫ জন সেখানে ছিলেন। অনেকে ভয় পেয়ে জানালা ভেঙে লাফিয়ে নিচে পড়ছিলেন। ‘আগুনে তার দুই বন্ধু মারা গেছেন’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনতে যান ব্যবসায়ী ফিরোজ আল মামুন ফয়সাল। দুটি পাঞ্জাবি পছন্দ করে টাকা পরিশোধ করছিলেন। ঠিক তখনই শুনতে পান ভবনটিতে আগুন লেগেছে। তাড়াহুড়া করে ভবনের তৃতীয় তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে নেমে যান ফিরোজ। কিন্তু বের হতে পারেননি। আবার সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার পাঞ্জাবির ওই দোকানে ঢুকে পড়েন। ততক্ষণে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো কক্ষ। বিদ্যুৎও চলে যায়। পুরো ভবনেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা ওই কক্ষে অনেকের সঙ্গে আটকে ছিলেন ব্যবসায়ী ফিরোজ। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর তাকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। পরে তাকে ভর্তি করা হয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। তিনি বলেন, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তখন মেঝেতে শুয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। পাঞ্জাবি ও রুমাল ভিজিয়ে মুখে পানি দিচ্ছিলাম। বেঁচে ফেরার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। তখন প্রতি সেকেন্ড ঘণ্টার মতো মনে হচ্ছিল। আমার ১০ মাসের একটি মেয়ে রয়েছে। ভয়াবহ ওই সময়টাতে শুধু মেয়ের ছবি চোখের সামনে ভাসছিল। ওর জন্য কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিল। তিনি জানান, আগুন লাগার খবর পেয়ে বাবা বারবার ফোন করছিলেন। কয়েকবার বাবার ফোন কেটে দেন তিনি। বেঁচে ফিরবেন কি না আর দেখা হবে কি না, সেটা ভেবে পরে বাবার ফোন ধরে দোয়া করতে বলেন।

মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের সন্তান ফিরোজ পরিবার নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকেন। সেখানে স্টার প্যাকেজিং নামে তার একটি কারখানা রয়েছে।

সাদ মাহমুদ ও ফিরোজ আল মামুনের মতো আগুনের মৃত্যুকূপ থেকে ফেরা অনেকের এখন ঠাঁই হয়েছে বার্ন ইনস্টিটিউটে। বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিউটে রাকিব হাসান (২৮), কাজী নাওশাদ হাসান আনান (২০), আজাদ আবরার (২৪), মেহেদী হাসান (৩৫) ও উম্মে হাবিবা (৩১) ভর্তি আছেন। এ ছাড়া একই ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি আছেন ইকবাল হোসেন (২৪) ও যোবায়ের (২১)। তাদের একেকজনের অভিজ্ঞতা একেক রকম কষ্টের। ওই দিনের ভয়াবহ আগুনের কথা স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন আহতরা। আগুনের ঝুঁকি ও অনুমোদন না থাকার পরও ভবনটিতে আটটি রেস্টুরেন্ট চলছিল বছরের পর বছর ধরে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে সেখানে খেতে ভিড় করেছিলেন নগরের বাসিন্দারা। কেউ গিয়েছিলেন শিশুসন্তানদের নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন স্বজনদের নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। কারও কারও জীবন চলত ওই ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। আগুনে এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢামেক হাসপাতালে ভর্তিরা কেউ শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

 

সর্বশেষ খবর