বুধবার, ৮ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

করছাড় প্রত্যাহারে সতর্ক হতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

করছাড় প্রত্যাহারে সতর্ক হতে হবে

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য করছাড় প্রত্যাহারে সতর্ক হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে করছাড়ের সুবিধা প্রত্যাহার করা হবে। যে সব প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল সেগুলো এখন কমাতে হবে। দক্ষতা, স্বচ্ছতা, সততা ও জনমানুষের কথা মাথায় রেখে এসব সুবিধা প্রত্যাহারের আগে সরকারকে আরও সতর্ক হতে হবে। কেননা এ সুবিধার কারণে যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উপকৃত হয়েছে সেগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া উচিত। গতকাল রাজধানীতে অর্থনৈতিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তিনি এ তাগিদ দেন। ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রয়াত সম্পাদক ও ইআরএফের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এএইচএম মোয়াজ্জেম হোসেন স্মরণে এ বক্তৃতার আয়োজন করে সংগঠনটি। ইআরএফ মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। বিশেষ অতিথি ছিলেন ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের বর্তমান সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ। একক বক্তৃতায় ড. দেবপ্রিয় বলেন, এবার সরকারের শক্তির জায়গা হলো ফসল ভালো হয়েছে। আউস-আমন-বোরোর উৎপাদন বেড়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রথম কাজ হবে সরকারি খাদ্য গোডাউনগুলো ভর্তি করা। স্টক বাড়ানো। বাজারকে প্রভাবিত করার জন্য স্টক হলো প্রথম কাজ। তিনি আরও বলেন, প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। এর ফলে দেশে প্রবাসীদের স্বজনরা টাকা পেলেও ডলার থেকে যাচ্ছে বিদেশে। প্রবাসী আয় দেশে আসার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হুন্ডি। বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় আনতে ২ বা ৩ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিয়ে হুন্ডি বন্ধ করা যাবে না। এটা নমনীয় হারে যেতে হবে। একইভাবে সুদের হার নমনীয় করতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, সুদের হার নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ মুহূর্তে মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতি সমন্বয় বিকল অবস্থায় আছে। একটি বেশি চলে যায়, আরেকটি পিছিয়ে যায়। এটার সমন্বয় দরকার। তিনি বলেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে চারটি ঘাটতি রয়েছে। ফলে জিডিপির আনুপাতিক হারে রাজস্ব আয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বোয়িংয়ের মতো। সরকারের বিনিয়োগ থেকে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। আমাদের দ্বিতীয় ঘাটতি হলো রাজস্ব আয়ে। জিডিপি বাড়লেও আনুপাতিক হারে রাজস্ব আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। আবার বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে। এর সঙ্গে আরেকটা বড় সমস্যা হলো-অতিমূল্যায়িত প্রকল্প। চলমান অতিমূল্যায়িত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসব প্রকল্পের কারণে অনেক অর্থের অপচয় ঘটছে। যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এতদিন গর্বের সঙ্গে দাবি করত যে দেনা পরিশোধে কখনো খেলাপি হয়নি। সে দাবি এখন আর থাকছে না। ঋণ পরিশোধ করতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। জ্বালানির বিল, বৈদেশিক কোম্পানির মুনাফা, বিদেশি এয়ারলাইনসের পাওনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫ বিলিয়ন ডলার যথাসময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতি সমন্বয় করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে। এটা দূর করতে হবে। একইভাবে মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদহারেও নমনীয়তা আনতে হবে। এখন শোনা যাচ্ছে রেমিট্যান্সের টাকা দিয়ে স্থানীয় শিল্প মালিকরা বিদেশে শিল্পের কাঁচামাল কিনছেন। এভাবে ২ বা ৩ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বাড়ানো যাবে না। এক্ষেত্রে আরও নমনীয় হতে হবে। সুদহারেও নমনীয়তা আনতে হবে। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশ এখন এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটছে। সরকার ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ বলছে। তথ্য নিয়ন্ত্রণ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখন রপ্তানি হচ্ছে তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের তথ্যে উঠে এলেও ‘টাকা আসছে না।’ আর তখনই তথ্য বন্ধ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময়ে এ উদ্যোগ নিয়েছে যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সরকারের সংস্কার উদ্যোগের ফলাফল বিশ্লেষণ করছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা তথ্য-উপাত্তের অপঘাত। আগে দেশের মধ্যে তথ্য-উপাত্তের নৈরাজ্য ছিল। এখন তথ্য-উপাত্তের অপঘাত হয়েছে। সবশেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা তারই প্রমাণ। এতে বোঝা যায় ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। আত্ম সংরক্ষণমূলক এ পদক্ষেপ সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা তখনই হয়, যখন বহুবাদ, গণতন্ত্র উঠে যায়। উর্দি পরা ও উর্দিবিহীন আমলারা এটা করেন। কারণ তারা জনমানুষের সামনে জবাবদিহি করতে ভয় পান। সরকারের কোথায় কী ব্যয় হচ্ছে তার সব তথ্য তাদের কাছে থাকছে। সংসদ সদস্যরাও সেই তথ্য জানেন না। সরকারের প্রতিনিধিদের যদি জনপ্রতিনিধিত্ব থাকত তাহলে এ অবস্থা হতো না। তিনি আরও বলেন, জনমানুষের প্রত্যাশার জায়গা, তথ্য-উপাত্তের বড় স্তম্ভ বাংলাদেশ ব্যাংক। আমরা বিবিএসের তথ্যের আগেই রপ্তানি-আমদানিসহ আর্থিক সূচক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের ওপরে নির্ভর ছিলাম। এখন কেন তথ্যের অপঘাত করা হলো, এতে সুনামহানি ঘটবে বাংলাদেশ ব্যাংকের। তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় সরকার বদল, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির জন্য ৯০ এর দশক বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অনন্য দশক। ওই সময় সমালোচকরাও বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনতা বোধ করতেন। ওই সময় নীতিপ্রণেতাদের সঙ্গে সমালোচক, সাংবাদিকদের গভীর ও আস্থার সম্পর্ক ছিল। নব্বইয়ের দশককে গণতন্ত্রের জন্য স্বর্ণযুগ বলা হয়।ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, তথ্য কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। আজ ব্যবসায়ীরা তথ্য পাচ্ছেন অথচ সাংবাদিকরা পাচ্ছেন না। ব্যবসায়ীকে তথ্য দিলে তো বাজারে এর প্রভাব পড়ে, দাম বেড়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সাংবাদিকদের সেখানে প্রবেশ করতেই দেওয়া হচ্ছে না। কেন তথ্য প্রকাশ হলে বড় ধরনের নাশকতা হবে? নাশকতাকারী কি অর্থনৈতিক সাংবাদিক?

সর্বশেষ খবর