চিটাগাং রোড এলাকার একটা সেলুনে কাজ করতেন আকতার হোসেন (১৯)। প্রতিদিনের মতো গত ২০ জুলাইও পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন সেলুনে। সহিংসতায় গুলি লেগে পা হারিয়ে এখন পঙ্গু তিনি। ব্যথা আর ক্ষত নিয়ে কাতরাচ্ছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল) শয্যায়। আকতার বলেন, ‘বিকালে চিটাগাং রোড এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসায় ফেরার জন্য বের হই। কিন্তু আবার গোলাগুলি শুরু হয়। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দৌড় শুরু করি। তখন একটা গুলি এসে আমার বাম পায়ে লাগে।’ আহত হওয়ার পর আমাকে এ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে।’ অপারেশন করে গত সোমবার তার বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ কেটে ফেলা হয়েছে। শুধু আকতার নয়, পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-২ ওয়ার্ডে শরীরে গভীর ক্ষত নিয়ে কাতরাচ্ছেন আরও ৩৫ রোগী। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে রাজধানীতে ছাত্র, পুলিশ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে আহত হয়েছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। রাজধানীর ১৮টি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ১৭ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনের সহিংসতায় ৫ হাজার ৬৪৪ জন মানুষ আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকার বাইরের চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জেও সহিংসতায় আহত হয়েছেন অনেকে। সব মিলিয়ে ৬ হাজার ২৩৮ জন আহত হওয়ার খবর মিলেছে। রাজধানীতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৩৫০টির বেশি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে অনেক হাসপাতাল বলছে, সঠিকভাবে হিসাব রাখা হয়নি, অনেকে বলছে আমরা ওইদিন ছিলাম না, অনেকে আহতদের তথ্য দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি রোগীর চাপ ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সহিংসতায় আহত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন ১ হাজার ৫৬০ জন। ভর্তি হয়েছেন ৩৭১ জন। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। এদের মধ্যে চোখের চিকিৎসা নিয়েছেন ২৫০ জন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১৩৮ জন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাজহারুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সহিংসতায় আহত হয়ে ১১৯ জন ভর্তি হয়েছেন। ১১৩ জন চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। বর্তমানে হাসপাতালে দুজন ভর্তি আছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রেজাউর রহমান বলেন, সহিংসতায় আহত হয়ে ১২০ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে ১১ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শাফিউর রহমান বলেন, সহিংসতাকালীন অবস্থায় হাসপাতালে ৬ শতাধিক আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন। এখনো ভর্তি আছেন ২২ জন। আহতদের মধ্যে ১৫০ জনের ছোটখাটো অপারেশন হয়েছে এবং ৩০ জনের বড় ধরনের অপারেশন হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় উত্তরা এলাকা পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। সহিংসতায় আহত রোগীদের ঢল নেমেছিল হাসপাতালগুলোতে। এত রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে হাসপাতালগুলোকে। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক মেজর (অব.) ডা. মো. হাফিজুল ইসলাম বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার সবচেয়ে বেশি রোগী এসেছে হাসপাতালে। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার রোগীর ঢল নেমেছিল। শুধু ওইদিনই ১৭৯ জন রোগীকে সেবা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই গুরুতর আহত ছিল। তাদের চিকিৎসা দিতে অনেকটা হিমশিম খেতে হয়েছে। কারণ এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসক ও নার্সের আরও বেশি প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা কেউই এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন না। তারপরও আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি সেবা দেওয়ার। সব মিলিয়ে ১৭-২০ জুলাই পর্যন্ত চার দিনে ২৬৩ জন রোগী সেবা নিয়েছেন। উত্তরা ক্রিসেন্ট ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারে ১৮ জুলাই এবং তার পরের দিন যে রাস্তায় বিক্ষোভ ও গুলির ঘটনা ঘটেছিল, সেই রাস্তাতেই ক্রিসেন্ট হাসপাতালের একাধিক ভবন। হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, ১৮ ও ১৯ জুলাই দুই দিনে এক শর মতো আহত রোগীকে তারা চিকিৎসা দিয়েছেন। প্রথম দিনে যারা এসেছিলেন, তারা প্রায় সবাই শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় দিনে যারা এসেছিলেন, তাদের অনেককেই ছাত্র মনে হয়নি বলে জানান তিনি। উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের লেক ড্রাইভ রোড। সেখানে রাস্তার দুই পাশে দুটি বহুতল ভবনে হাই-কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল। এই হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানালেন, ১৮ জুলাই দুপুরের পর এই হাসপাতালে ৩৫-৩৬ জন আহত শিক্ষার্থী এসেছিলেন। তারা ছররা গুলি, টিয়ার শেল ও ইটপাটকেলের আঘাতে আহত ছিলেন। উত্তরা এলাকার শিন-শিন জাপান হাসপাতালে ১৮-১৯ জুলাই ২৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই হাসপাতালে ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই ২৬৫ জন আহত ব্যক্তি এসেছিলেন। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে বেসরকারি শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, সংঘর্ষের প্রথম দুই দিনে ১৭৫ জন আহত ব্যক্তি এই হাসপাতালে আসেন। তাদের অধিকাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী। আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় উত্তাল ছিল রামপুরা-বনশ্রী এলাকা। সহিংসতায় আহত রোগীদের অনেককে চিকিৎসা দিয়েছে বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফরাজী হাসপাতালের তথ্য কর্মকর্তা ও উপ-ব্যবস্থাপক মো. রুবেল হোসেন বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে রামপুরা ও বনশ্রীতে পুলিশ-আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে আহতদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা আমরা করেছি। ১৮ জুলাই ৩০০-এর মতো আহত মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরদিন শুক্রবার জুমার নামাজের পরপরই চতুর্দিক থেকে আহত মানুষ আসতে থাকে। যাদের প্রায় সবাই ছিল গুলিবিদ্ধ।
আহতদের মধ্যে শিশু এবং পুলিশও ছিল। শুধু শুক্রবারই ৬০০ রোগীকে সেবা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ, ছাত্র, পথচারী রয়েছেন। আর শনিবার চিকিৎসা নিতে আসেন ৫০ জন। সব মিলিয়ে তিন দিনে ৯৫০ জনের বেশি আহত মানুষ এসেছেন। যাদের ৯০ ভাগই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। গুরুতর আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে করে মুগদা ও ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। ডেলটা হেলথ কেয়ারে ১৮ জুলাই আহত অবস্থায় ২৫-৩০ জন শিক্ষার্থী এসেছিলেন। বেটার লাইফ হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, অন্তত ৩০০ জন আহত অবস্থায় হাসপাতালে আসেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক বদরুল আলম বলেন, বিক্ষোভ-সংঘাতের ঘটনায় নিউরো সায়েন্সেসে মোট ১৩২ জন চিকিৎসা নিতে আসেন। তাদের মধ্যে ১০০ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর ৩২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৮ জুলাই থেকে ২১ জুলাই সহিংসতায় আহত হয়ে ৫১৮ জন চিকিৎসার জন্য আসেন। এর মধ্যে ১০০ জন হাসপাতালে ভর্তি হন বলে জানা গেছে। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটেই চিকিৎসা নিয়েছেন ৪২৯ জন। বেশির ভাগেরই চোখে গুলি লেগেছে। চিকিৎসকরা জানান, আহতদের অনেকে হারাতে পারেন দৃষ্টিশক্তি। ১৭ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত চোখে গুলি নিয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪২৯ জন। এর মধ্যে ২৯১ জনের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে এই হাসপাতালে হাতে, পায়ে, বুকে ও চোখে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ২২ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) ও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। ঢাকার বাইরেও সহিংসতায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। আমাদের প্রতিনিধিরা জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনে দিনাজপুরে সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও কেউ নিহত হননি। তবে আহত হয়েছেন এবং এরই মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন বলে জেলা প্রশাসন জানায়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ নুর এ আলম জানান, কোটা আন্দোলনের ঘটনায় দিনাজপুরে ৪৪ জন আহত হয়েছেন এবং চিকিৎসা নিয়ে তারা বাড়ি ফিরেছেন। গাইবান্ধায় সহিংসতায় আহত হয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, দলীয় নেতা-কর্মী, পুলিশসহ প্রায় শতাধিক মানুষ। চট্টগ্রামে সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়েছেন প্রায় দুই শতাধিক মানুষ। টাঙ্গাইলে পোস্ট অফিস, জেলা আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর ও পুলিশের সঙ্গে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, নিরালার মোড়সহ কয়েকটি স্থানে সংঘর্ষে আন্দোলনকারী, সাংবাদিক, পুলিশসহ অন্তত ৫০ জন আহত হন। কিশোরগঞ্জে কোটা সংস্কার আন্দোলনে দুই শতাধিক আহত হয়েছেন।