রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ করে হাই কোর্ট বলেছেন, জাতির সঙ্গে মশকরা করবেন না। যাকেই ধরে নেন (ডিবি অফিসে), একটা খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন। এগুলো কেন করতে গেলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়কের মুক্তি এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে করা এক রিটের শুনানিতে গতকাল বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাই কোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা এ রিট আবেদনটি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সারা হোসেন, আইনজীবী অনীক আর হক ও মানজুর-আল-মতিন শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ ও মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী শুনানিতে অংশ নেন, সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি ও আদেশের জন্য আজকের দিন রেখেছেন আদালত। শুনানিতে প্রথমে আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন বলেন, আন্দোলনকারীদের ওপর অবাধে গুলি ছোড়া হচ্ছে। বিবিসি, আল জাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ভিডিও ফুটেজ আছে। আন্দোলনকারীদের হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকারি বাহিনীগুলো ছিল সশস্ত্র। বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ছিল নিরস্ত্র। গত কয়েক দিনের ভিডিও ফুটেজ আমরা দিতে পারব। হাই কোর্ট তখন বলেন, বিবিসি বাংলাসহ অনেক বিদেশি মিডিয়ায় নিউজ বিকৃত করে প্রচার করেছে। সুতরাং ওইসব নিউজ আসলে অকাট্যভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। মানজুর বলেন, স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৪৭ জনের মৃত্যুর কথা বলেছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম দুই শতাধিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছে। সে সবের ভিডিও ফুটেজ আছে। ভিডিও ফুটেজগুলো কীভাবে অস্বীকার করবেন? এ সময় আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন শিশুর মৃত্যুর কথা তুলে ধরে মানজুর বলেন, একটি শিশু ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। এ সময় আদালত জানতে চান, এর দায় কার? মানজুর বলেন, নিঃসন্দেহে এটা সরকারের দায়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার কোনো সুযোগ নেই। ছয়জন সমন্বয়কারীকে ডিবি তুলে নিয়ে গেছে। ডিবি বলছে, নিরাপত্তার জন্যই তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাহলে তাদের দিয়ে বিবৃতি দেওয়ানো হলো কীভাবে? এখানে সবাই বাংলাদেশের মানুষ। কেউ পাঞ্জাব থেকে আসেনি। এ সময় হাই কোর্ট বলেন, এখানে অনেক রাজনৈতিক বিষয় জড়িত আছে। সুতরাং কোর্ট যাতে বিতর্কিত না হয়। এর পর আইনজীবী অনীক আর হক শুনানিতে দাঁড়িয়ে বলেন, আমাদের আরজি হলো তাজা গুলি ছোড়া বন্ধ করা। তাতে প্রাণ রক্ষা হবে। দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে সেটাও আমরা চাই না। কিন্তু যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তারাও দেশের সম্পদ। অবশ্যই তাজা গুলি বন্ধ করা উচিত। আন্দোলন দমন করার আরও অনেক উপায় আছে।
শুনানিতে সারা হোসেন বলেন, যাদের তুলে নেওয়া হয়েছে বলা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য তুলে নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা শাখা বলছে, তাদের গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়নি। হেফাজতে আছে। কিন্তু সংবিধানে এমন কোনো সুযোগ নেই। এমনকি কোনো আইনেও নেই। তাহলে তাদের কেন কোনো আদালতে হাজির করা হচ্ছে না বা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না। এটা কোনোভাবেই গ্রেপ্তার নয়। তাহলে এভাবে আটক রাখার ক্ষমতা তারা কোথায় পেল?
জেড আই খান পান্না বলেন, আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে যা হচ্ছে তা মেনে নেওয়া যায় না। আদালত তখন বলেন, কোটার সমস্যা তো আপিল বিভাগে সমাধান হয়েছে। পান্না বলেন, সমস্যার তো সমাধান হয়নি। একাত্তর সালে দরজায় নক করে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজা হতো। এখন রাতের আঁধারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্লক রেইড দেওয়া হচ্ছে। দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ছাত্র আছে কি না। তাদের মোবাইল কেড়ে নিয়ে চেক করা হচ্ছে। এটা কি আইনসঙ্গত?
রাষ্ট্রপক্ষে প্রথম শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কীভাবে আইনের প্রয়োগ করবে, সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। যারা রিট আবেদন নিয়ে এসেছেন তারা কি নিশ্চয়তা দিতে পারবে, আর বিটিভি, সেতু ভবন, মেট্রোরেলে হামলা হবে না? নরসিংদীর জেলে হামলা হয়েছে। সেখানকার বন্দিরা পালিয়েছে। এটা কীসের ইঙ্গিত? তখন আদালত বলেন, এ ঘটনার আগে মিছিলে একটি ছেলে গুলি খেয়ে মারা গেছে। তার পর এ ঘটনা ঘটেছে। উ™ভূত পরিস্থিতিতে একটা মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতা) গিয়ে সেখানে হামলা হয়েছে। এ সময় মেহেদী হাছান বলেন, দেশে যদি মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতা) হয় সেখানে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন প্রয়োগ করতে পারবে না? যারা মারা গেছে তাদের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ যদি বেআইনিভাবে গুলি করে থাকে তাহলে তদন্তসাপেক্ষে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হবে এবং হচ্ছে। এই রিট আবেদনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। শুনানিতে তিনি বলেন, আমরা দেখতে পেয়েছি যে, ডিবি অফিসে ছয়জন কাটা চামচ দিয়ে খাচ্ছেন। তখন আদালত বলেন, ওইগুলা করতে আপনাদের কে বলেছে, কেন করলেন এগুলা? জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না। যাকেই নেন ধরে, ওখানে একটা খাবার টেবিল বসিয়ে দেন। জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না। এ পর্যায়ে অতিরিক্তি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, দুই পক্ষেই হতাহত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবৈধ উপায়ে বল প্রয়োগ করেছে, এই বিষয়টি আবেদনে কোথাও বলা নেই। তারা ভিত্তিহীন ধারণার ওপর আবেদনটি নিয়ে এসেছে। আদালত তখন বলেন, যদি ওই ছয় ছাত্রকে আটক না করে থাকেন, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করেন। মোরশেদ বলেন, তাদের পরিবার কী বলছে সেটি দেখতে হবে। ডিবি বলেছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ২০০ লোক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে, এটার প্রমাণ কী? এ সময় এজলাসে উপস্থিত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজাহার উল্লাহ ভূঁইয়ার বক্তব্য শোনেন আদালত। আজাহার উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, আমরা দেশে শান্তি চাই। সহিংস পরিস্থিতি চাই না। আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলন নেই। তার পরও আন্দোলন হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান, আইন এবং সার্বিক বিবেচনা করে একটি আদেশ দেওয়া প্রয়োজন।