ড. মুহাম্মদ ইউনূস, এক নামেই যাকে জানে গোটা বিশ্ব। চট্টগ্রামের জোবরা গ্রাম থেকে শুরু হয়েছিল তার সামাজিক ব্যবসার মডেল তথা ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের। যা এরই মধ্যে বিশ্বে সমাদৃত। এজন্য একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার নোবেলও জয় করেছেন ড. ইউনূস। এবার সেই ড. ইউনূসই হলেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এই সংকটকালীন মুহূর্তে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালনের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা প্রস্তাব করেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম। শিক্ষার্থীদের দাবি এবার আর উপেক্ষা করতে পারেননি ড. ইউনূস। দেশের ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে এসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে গতকাল দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তিনি। ৮৪ বছর বয়সে এসে ড. ইউনূস তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর তরুণদের সম্মিলনে নতুন বাংলাদেশ গড়ার নবযাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ পরিচালনার জন্য গঠিত হতে যাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেন। এর পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। গত মঙ্গলবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ৩ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা বৈঠকের পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত আসে। গতকাল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূস শপথ এবং দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে দুপুরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ঢাকায় ফিরে শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রেসব্রিফিংয়ে দেশবাসীর উদ্দেশে এই নোবেলজয়ী বলেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন’। এ সময় তিনি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘এ স্বাধীনতা আমাদের রক্ষা করতেই হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. ইউনূস তার সামাজিক ব্যবসার মডেলটি শুরু করেন ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রাম থেকে। সেখানেই আর্থ-সমাজিক উন্নয়ন গবেষণা করতে গিয়ে তিনি পরীক্ষামূলক অনুশীলন হিসেবে চালু করেন ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প। এর উপকারভোগীরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসেন দারিদ্র্যসীমা থেকে। সময়ের পরিবর্তনে ১৯৮৩ সালে এই মডেল রূপ নেয় গ্রামীণ ব্যাংক হিসেবে। এর পর কেটে যায় অনেকগুলো বছর। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন মামলা দিয়ে তাকে এবং তার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকে কর্মরতদের নাজেহাল করা শুরু হয়। দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে মামলার পর মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করা হয়। গত জুলাই মাসের গোড়ার দিকে সরকারি চাকরিতে কোটার বিরোধিতা (পরে সংস্কার) করে শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করেন। ছাত্রসমাজের ওপর নেমে আসে হাসিনা সরকারের জুলুম-নির্যাতন। পুলিশের গুলিতে অসংখ্য ছাত্র ও সাধারণ আন্দোলনকারী নিহত হন। আহত হন কয়েক সহস্র মানুষ। ১০ হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ অবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ৪ আগস্ট থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ওইদিন সারা দেশে পুলিশের গুলিতে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঢাকা অভিযান কর্মসূচির মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ওইদিনই দেশত্যাগ করেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় ছাত্র-জনতার বিজয়। এর পরই গত ৭ আগস্ট শ্রমআইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ড. ইউনূসের ছয় মাসের সাজা বাতিল করেন শ্রমআপিল ট্রাইব্যুনাল।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৪০ সালের ২৮ জুন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রামের হাটহাজারির কাপ্তাই সড়কের বাথুয়া গ্রামে একটি বাঙালি মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৪ সালে তার পরিবার চট্টগ্রাম শহরে চলে আসে এবং তিনি তার গ্রামের স্কুল থেকে লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং তদান্তীতন পূর্ব পাকিস্তানের ৩৯ হাজার ছাত্রের মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করেন। পরে ইউনূস চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বিএ এবং ১৯৬১ সালে এমএ সম্পন্ন করেন। স্নাতক শেষ করার পর তিনি নুরুল ইসলাম এবং রেহমান সোবহানের অর্থনৈতিক গবেষণায় গবেষণা সহকারী হিসেবে অর্থনীতি ব্যুরোতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৬৫ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ড. ইউনূস মার্ফ্রিসবোরোতে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। সেখানে অন্য বাঙালিদের সঙ্গে বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র পরিচালনা করেন। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। অধ্যাপক ইউনূস দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম শুরু করেন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময়। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন জোবরা গ্রামে। ১৯৭৪ সালে মুহাম্মদ ইউনূস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে। পরে দারিদ্র্যদূরীকরণে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে প্রান্তিকসীমায় থাকা অতিদরিদ্রদের মাঝে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণের ধারণাকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেন তিনি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন গরিব বাংলাদেশিদের মধ্যে ঋণ দেওয়ার জন্য। ঋণের টাকা ফেরত নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ‘সংহতি দল’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। একটি অনানুষ্ঠানিক ছোট দল একত্রে ঋণের জন্য আবেদন করে এবং এর সদস্যবৃন্দ একে অন্যের জামিনদার হিসেবে থাকে এবং একে অন্যের উন্নয়নে সাহায্য করে। ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরিবকে রক্ষা করার জন্য ব্যাংক অন্যান্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্পসহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা। পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয় নোবেল পুরস্কারকে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তার নিরলস লড়াইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সর্বোচ্চ এই সম্মান পেয়েছেন। এ পুরস্কার ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’, ‘কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’সহ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২৮ জুন তার জন্মদিনকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিকভাবে ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
এখন পর্যন্ত দারিদ্র্যদূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার এই মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে। এ ছাড়া পৃথিবীর ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তার নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে ড. ইউনূসের চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তার জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়। এখন পর্যন্ত ২৪টি দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ৬০টির মতো সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন। ১৩০টির বেশি সম্মাননা পেয়েছেন ৩০টির বেশি দেশ থেকে। কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ড. ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত কয়েক দশকে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ শক্তিসহ ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর অধ্যাপক ইউনূসকে রাশিয়ার ফিন্যান্সিয়াল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। টোকিও অলিম্পিকে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি তাকে ‘অলিম্পিক লরেল’ সম্মাননা দিয়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফুটবল সামিটে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়া, তিনি জাতিসংঘ এবং বেসরকারি বৈশ্বিক ফাউন্ডেশনসহ প্রায় সব বহুপক্ষীয় সংস্থার উপদেষ্টা পর্যায়ে কাজ করেছেন। এর বাইরেও তিনি বেশকিছু ইউরোপীয় দেশের রাজকীয় সম্মাননা পেয়েছেন। চলতি প্যারিস অলিম্পিকেও শুভেচ্ছাদূত হয়ে ২০০ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এই নোবেলজয়ী।
মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় রাজনৈতিক দল গঠনের কার্যক্রম করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব হারানোসহ বিভিন্ন মামলায় আদালতে বারবার হাজিরা দিতে হয়েছে অধ্যাপক ইউনূসকে। গ্রেপ্তারের আশঙ্কায়ও ছিলেন তিনি।
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন মামলা দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ মামলা দিয়ে ড. ইউনূসকে হয়রানি করা হচ্ছে বলে জানান বিশ্ব নেতারা। তিনি নিজ দেশেই গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ছিলেন কোণঠাসা। কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন নিজের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের।
ওয়ান-ইলেভেনে অধ্যাপক ইউনূস
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সমর্থনে ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। সেই সময় অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে একটি দল গঠনের আলোচনাও ছিল জোরাল। এই সময় রাজনৈতিক দল গঠন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিবিসি বাংলার সঙ্গে কথা হয়েছিল অধ্যাপক ইউনূসের। তিনি জানান, সে সময়কার সেনাবাহিনী প্রধান তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। তবে তিনি তা নাকচ করে দিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে নাগরিক শক্তি নামে একটি দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।
পরবর্তী সেই প্রক্রিয়া থেকেও সরে এসেছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ব্যক্তি আক্রোশ নেমে আসে ড. ইউনূসের ওপর। যার প্রথমটা শুরু হয় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে এই নোবেল বিজয়ীকে একরকম জোরপূর্বক অব্যাহতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। ২০১১ সালের ২ মার্চ গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে অপসারণের আদেশ জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিরুদ্ধে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নয়জন পরিচালক দুটি রিট মামলা করেছিলেন। দুটি রিট আবেদনই খারিজ করে দিয়ে হাই কোর্ট ড. ইউনূসকে তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশ বহাল রাখেন। পরে ওই বছরের ১২ মে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইস্তফা দেন অধ্যাপক ইউনূস। ক্ষমতায় আসার পরই পদ্মা সেতু তৈরিতে প্রকল্প প্রস্তুত করে বাংলাদেশ। সে সময় অর্থায়নে রাজিও হয় বিশ্বব্যাংক। কিন্তু মাঝপথে সেই অর্থায়ন আটকে যায় দুর্নীতির অভিযোগে। এর পর বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ তোলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রভাবিত করার কারণেই আটকে গিয়েছিল পদ্মা সেতুর অর্থায়ন। গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনুস বলেন, ‘আমার বাধা দেওয়ার তো কোনো কারণ নেই। বিশ্বব্যাংক তো আমার প্রভাবিত করার জন্য অপেক্ষা করেনি। তারা তো বলছে দুর্নীতি হয়েছে’। এই সময় অধ্যাপক ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ট্রাস্টের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়। অবশেষে গণ অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে মামলা থেকে খালাস লাভ করেন এই বরেণ্য নোবেলবিজয়ী।