ব্যবসাবাণিজ্যে আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলেছেন, গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া ব্যবসার উন্নতি হয় না। একই সঙ্গে তারা দেশের বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা, হয়রানিমুক্ত ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়েও জোর দিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিগত রাজনৈতিক সরকার তাদের সার্বক্ষণিক গ্যাস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এর পরও গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে কারখানাগুলো বন্ধ থাকছে। এ পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান চান ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি চলমান অস্থিরতার কারণে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে তুলতে প্রধান উপদেষ্টার বিবৃতি দাবি করেছেন। তাদের সমস্যাগুলোর সমাধানে দেশের সব সেক্টরের ব্যবসায়ীদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে একটি বৈঠক আয়োজনের দাবিও উঠে এসেছে। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ব্যবসায় সম্মেলনে এসব বিষয় উঠে আসে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ। আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে এতে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভাইস চেয়ারম্যান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু। ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্দেশ করে বক্তব্যের শুরুতে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আমাদের মধ্যে যেন কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি না হয় সে লক্ষ্যে এই সম্মেলন ডাকা হয়েছে। তিনি বলেন, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থক থাকবে। তার মানে এই নয়, যে যখন সুযোগ পাব দল বদলাব। কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি তা চিহ্নিত করা ব্যবসায়ীদের কাজ নয়। ব্যবসায়ীদের কাজ বাণিজ্য সংগঠন ও ব্যবসার সংকট তুলে ধরে তা সমাধানে সরকারকে চাপ দেওয়া। রাজনৈতিক প্রভাবে যেসব বাণিজ্য সংগঠনে পর্ষদ গঠন হয়েছে, সেসব সংগঠনের নেতাদের উদ্দেশে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, যে যে দলেরই নেতা হোন না কেন, কোনো সমস্যা নেই। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন। যদি তা না করতে পারেন, দায়িত্ব ছেড়ে দেন। বিএনপির এই ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশ একটা বিরাট রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। অফুরন্ত সমস্যা আমাদের। আমরা চাই অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হোক। যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো নেই। গণতন্ত্র এবং অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক। একটাকে ছাড়া আরেকটা চলতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সর্বোত সমর্থন জানিয়ে মিন্টু আরও বলেন, কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন আছে, যা করতে হবে। সেই সংস্কার সম্পন্ন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে দেশে সাংবিধানিক অধিকার, মৌলিক অধিকার, ভোটের অধিকার ফেরত আসুক। কারণ, এখানে অনেকে মনে করেন, দীর্ঘদিন থেকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছেন তারা। সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার কাজ শেষ করে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। মিন্টু বলেন, সমাজ এখন রাজনীতি শূন্য, অর্থনীতি এর থেকে খারাপ হতে পারে না। বিগত তিন বছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিচের দিকে। উচ্চমূল্যস্ফীতি আরও বেশি ওপরের দিকে উঠছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৬ শতাংশ। এতে করে উচ্চবিত্তের সমস্যা না হলেও খারাপ অবস্থায় রয়েছে দেশের নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ। তিনি আরও বলেন, দেশের সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নেই। ৩০ লাখ শ্রমিক প্রতি বছর চাকরির বাজারে ঢুকছে। অথচ আমাদের সামাজিক মূলধন গড়ে উঠছে না। এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বিনিয়োগের ৯৭ শতাংশ আসে নিজের দেশের সঞ্চয় থেকে। যে দেশের মানুষের সঞ্চয় চলে যায় মূল্যস্ফীতির কারণে, সে দেশে সামাজিক মূলধন গড়ে উঠবে না। আর সামাজিক মূলধন ছাড়া বিনিয়োগ করেও লাভবান হবে না। এই সামাজিক মুনাফার জন্য গণতন্ত্র দরকার। জবাবদিহিতা নেই, এমন কোনো সরকার কোনো দেশে কোনোকালে উন্নয়ন করতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন বিএনপির এই ভাইস চেয়ারম্যান। সভাপতির বক্তব্যে আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, কোনো বাণিজ্য সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদ গায়েব করে দেওয়া যাবে না। এ ধরনের কিছু করা হলে ভবিষ্যতেও তা ঘটবে। যা কিছু করতে হয়, সিস্টেম অনুযায়ী করতে হবে। আপনার ১৫ বছর অপেক্ষা করতে পারলে পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনের জন্য আর পনেরো মাস অপেক্ষা করতে পারবেন। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য সংগঠন পরিবর্তনের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। অন্তর্বর্তী সরকার স্থিতিশীল হলে ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর যাবতীয় সমস্যা সরকারের সামনে তুলে ধরা হবে বলেও জানান তিনি। ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের নিয়ে অনুষ্ঠানটি ডাকা হলেও এতে বাণিজ্য সংগঠনগুলোর বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের নেতাদের দেখা যায়নি। ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, একে আজাদ, জসীম উদিন, স্কয়ার গ্রুপের তপন চৌধুরী, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান, এস এম ফজলুল হক, বারবিডার সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন, আবদুল হক, বিটিএমএর সভাপতি শওকত আলী রাসেল, ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সবুর খান, রিজওয়ার রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আনোয়ার হোসেন, সিলেট চেম্বার্স অব কমার্সের প্রতিনিধি আলিমুর রেজা প্রমুখ। ব্যবসায়ীরা তাদের বক্তব্যে এফবিসিসিআইসহ দেশের বাণিজ্য সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের পরিবর্তনের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বাণিজ্য সংগঠন গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
মীর নাসির হোসেন বলেন, বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর হয়েছে। বিপ্লবের পর এটি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যা হয়েছে- চাঁদা, এটা বন্ধ করতে হবে। তিনি রাষ্ট্রীয় সংস্কারের পাশাপাশি এনবিআরসহ আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেন। এ কে আজাদ বলেন, ব্যবসায়ীদের দুই ধরনের সংস্কার দরকার। বাণিজ্য সংগঠনগুলোর সংস্কারের পাশাপাশি ব্যবসায়িক ইতিবাচক পরিবেশ নিশ্চিত করতে সংস্কার জরুরি। এই মুহূর্তে বাণিজ্য সংগঠনের সংস্কারের তুলনায় ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে মনোযোগ বেশি দরকার। জসিম উদ্দিন বলেন, এফবিসিসিআই-এ যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে বিভেদ থাকতে পারে। একেকজন একেক দল করতে পারি। কিন্তু ব্যবসায়ীদের এখন নিজেদের স্বার্থে সেই বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজন করতে হবে।