বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম বলেছেন, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারপতির গাউন পরিয়ে আদালতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে নিরীহ জনগণের ওপর অত্যাচার করার জন্য। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদেও অত্যাচার করার জন্য। আইনসভা যেহেতু নির্বাচিত নয়, তারা প্রধানমন্ত্রীর স্তুতিগান গাওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি।
গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক আন্দোলনে পতিত সরকারের গণহত্যা, আওয়ামী লীগ সরকারের যাবতীয় অপকর্মসহ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার বিভাগ, বিডিআর হত্যাকান্ডসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী এই রাজনীতিক। সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশের মানুষকে সবচাইতে বেশি কষ্ট দিয়েছে পতিত এই শেখ হাসিনার সরকার। মানুষ এতে ক্ষোভ কিংবা দুঃখটাও পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারেনি। চোখ ও মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করতে হয়েছে। ঘরের ভিতরে বসে বসে কান্না করতে হয়েছে তাদের। বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, শনিবার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সভায় আমরা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এত অপকর্ম এবং অসংখ্য গুম-খুনের নির্দেশদাতা ও রাজপথে ছাত্র-তরুণদের গণহারে হত্যা করার জন্য দায়ী শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, দেশের বিচার বিভাগও আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ বিভাগে পরিণত হয়েছিল। তারা প্রধানমন্ত্রীকে তৈলমর্দন ছাড়া আর কিছুই শেখেনি। নির্বাহী বিভাগের নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছে বিচার বিভাগ। অসংখ্য মিথ্যা মামলায় আমরা জড়িত। আমার বিরুদ্ধেই ১২টি মামলা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এখন বাংলাদেশের মানুষের সব আশাভরসার স্থান উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করি তিনি ১৬ বছরের সব জঞ্জাল পরিষ্কার করে দেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিয়ে যাবেন।
বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ড. ইউনূস বাংলাদেশের গৌরব। সারা পৃথিবীতে তিনি একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। সারা বিশ্ব তাঁকে সম্মান করে। কিন্তু পতিত সরকার-পতিত স্বৈরাচার তাঁকে সারা বছরই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। কারাগারে পাঠানোর চেষ্টা করেছে। ছয় তলায় হেঁটে হেঁটে তাঁকে উঠতে হয়েছে। লিফট ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। যতভাবে একজন মানুষকে হেনস্তা করা যায় ড. ইউনূসকে সেভাবেই নাজেহাল করেছে। এখন বাংলাদেশের প্রধান আশাভরসা ড. ইউনূস। তাঁর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দীর্ঘদিনের জঞ্জাল দূর করবে। সমস্যাগুলো সমাধান করবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করবে। অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে বলে আমরা আশা করি। পরিবেশ অনুকূল হলে তারা নিশ্চয়ই আশা করি একটি অবাধ, সুুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। আমরাও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি দেশের জনপ্রিয়তম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। বিএনপির নেতৃত্ব দেবেন এবং দেশবাসীর ব্যাপক সমর্থন নিয়ে ইনশাল্লাহ তিনি আবারও দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, দেশবাসী অত্যন্ত উৎফুল্ল। স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার পথে অগ্রযাত্রা সাধিত হয়েছে। দেশবাসী দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন হয়েছে বলে মনে করি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে তারা এ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সব বিরোধী রাজনৈতিক দল এ ১৬ বছর পর্যন্ত যা করতে পারেনি, লড়াকু তরুণ ছাত্রছাত্রীরা এ অসাধ্য সাধন করেছে। আমি তাদের আমার আন্তরিক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাই। বিএনপির এই রাজনীতিবিদ আরও বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের রিজার্ভ লুণ্ঠন করেছে একদল আওয়ামী ব্যবসায়ী। সরকারের আনুকূল্য নিয়েই দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী এবং ব্যবসায়ীরা। যার ফলে গড়ে উঠেছে কানাডার বেগমপাড়া, আমেরিকা/জার্মানির সেকেন্ড হোম, থার্ড হোম। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম। এমনকি লন্ডনে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ৩০০ বাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর পিয়নের ৪০০ কোটি টাকা, তিনি হেলিকপ্টারে চলাচল করতেন। এতেই প্রমাণিত হয় কী দুঃশাসনের ভিতর দিয়ে মানুষ ১৬টি বছর পার করেছে। এ ১৬ বছরে তারা সৃষ্টি করেছে আয়নাঘর। যেখানে ভিন্নমতাবলম্বী নিরীহ মানুষকে নিয়ে টর্চার করা হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে গুম ও খুন করা হয়েছে কেবল আওয়ামী লীগকে সমর্থন না দেওয়ার ফলে। দেশের বুদ্ধিজীবী মানুষেরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলেন। দেশের এ দুর্দিনে তারা কেউ কোনো ভূমিকা রাখেনইনি, বরং শেখ হাসিনাকে তৈলমর্দন করে আরও উৎসাহিত করেছেন ছাত্র-জনতার ওপর স্টিম রোলার চালাবার জন্য। মেজর (অব.) হাফিজ আরও বলেন, শেখ হাসিনার সাহায্য নিয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ী বেশ কয়েকটি ব্যাংক লুটপাট করে সেগুলো দেউলিয়া করে দিয়েছেন। রাষ্ট্রকে পরিণত করেছে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী ভয়াবহ এক দানব বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষকে তারা পদতলে পিষ্ট করেছে। এমনকি একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহাকে থানার ওসি প্রদীপ কুমার গলায় পা দিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। না সামরিক বাহিনী কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছে, না পুলিশ বাহিনী কোনো উদ্যোগ নিয়েছে। পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদে যারা ছিল তারা ব্যাপক লুটতরাজ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই নেতা আরও বলেন, নির্বাচনের নামে গত তিনটি প্রহসন মঞ্চস্থ হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রেখেছে। সব দিকের বিচারে বাংলাদেশ সব দিক থেকেই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে চলছিল। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছে আবু সাঈদের মতো লড়াকু বীর সৈনিকেরা। যারা জীবন দিয়ে বাংলাদেশকে আবার গণতন্ত্রের ট্র্যাকে নিয়ে এসেছে। আমরা অনেক আশা করে প্রফেসর ড. ইউনূসের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি এসব জঞ্জাল পরিষ্কার করে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিয়ে যাবেন। এ আশা পোষণ করি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সার্বিক সাফল্য কামনা করছি। এ সময় তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, পতিত সরকারের প্রেতাত্মারা এখনো যার যার জায়গায় বসে আছে। এদের দ্রুত প্রশাসনের বিভিন্ন স্থান থেকে উৎপাটিত করতে হবে। এটা হবে টপ প্রায়োরিটি। এরপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের ১০০ দিনের কর্মসূচি নিয়ে শর্ট টার্ম এবং মিড টার্ম পরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সংস্কার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনের উল্লেখ করে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর থেকে ফিরে এলে যে সংবাদ সম্মেলনটা হয় সেটি জনগণের জন্য অনেক বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে। সাংবাদিক যে এত নষ্ট হয়ে যেতে পারে এ অনুষ্ঠানটা দেখলেই বোঝা যায়। ইতোমধ্যে তৈলমর্দন করে অনেকে গাড়ি, বাড়ি, নগদ টাকার সুযোগসুবিধা বাগিয়ে নিয়েছে। এ রাষ্ট্রের এ করুণ অবস্থা দেখে দুঃখভারাক্রান্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আশা করি এবার সাংবাদিকসমাজ মুক্তমনে লিখতে পারবেন এবং তাদের নেতৃত্ব দেবেন প্রকৃত সাংবাদিকরা। কোনো মতলববাজ নয়।