সারা দেশে স্থানীয় সরকার বিভাগের ১৮৭৬ জনপ্রতিনিধিকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেছে সরকার। এরা হলেন- ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়র, ৬০ জেলা, ৪৯৩ উপজেলা চেয়ারম্যান, ৪৯৪ ভাইস চেয়ারম্যান, ৪৯৪ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং ৩২৩ পৌরসভার মেয়র। একই সঙ্গে জনপ্রতিনিধিশূন্য এসব স্থানে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রণালয়। অপসারণের পাশাপাশি মৃত্যুজনিত কারণে যেসব স্থানে জনপ্রতিনিধিশূন্য হয়েছে সেখানেও প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে গতকাল পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলরদের অপসারণের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
ছাত্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বেশির ভাগই আত্মগোপনে চলে গেছেন। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দখলে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হতে থাকে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অনুপস্থিত থাকায় নাগরিক সেবা ব্যাহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে আইন সংশোধনের এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ এবং প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে রেখে পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশনের আইন সংশোধনের আলাদা অধ্যাদেশ শনিবার রাতে জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর পর এই জনপ্রতিনিধিদের অপসরাণ করা হয়। এদিকে, দেশের যেসব সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করা হয়েছে এগুলো হলো ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ। তাদের জায়গায় প্রশাসক বসানো হয়েছে। তারাই দায়িত্ব পালন ও দেখভাল করবেন সিটি করপোরেশনগুলোর। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মহ. শের আলীকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক মাহমুদুল হাসানকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) মহাপরিচালককে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রশাসক করা হয়েছে। বাকি সিটিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনার প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন।
এদিকে, স্থানীয় সরকার বিভাগের জারি করা পৃথক প্রজ্ঞাপনে ৬০ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে পৃথক আদেশ জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। মৃত্যুজনিত কারণে নাটোর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়। সব মিলিয়ে খালি হওয়া ৬১টি জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা ব্যতিত ৬১ জেলার মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর- এই আট জেলায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাকি ৫৩ জেলায় অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসিরা। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি ৪৯৩ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ৯৮৮ ভাইস চেয়ারম্যান /মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যানদের স্থলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) দায়িত্ব পালন করবেন। মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৪ এর ধারা ১৩(ঘ) প্রয়োগ করে বাংলাদেশের ৪৯৩ উপজেলা চেয়ারম্যানদের স্ব স্ব পদ থেকে অপসারণ করা হলো। প্রজ্ঞাপনে মৃত্যুজনিত কারণে কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়। অপসারণকৃত চেয়ারম্যানদের স্থলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যদিকে, আওয়ামী সরকারের আমলে নির্বাচিত ৩২৩ জন পৌর মেয়রকে অপসারণ করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৪ এর ধারা ৩২(ক) প্রয়োগ করে বাংলাদেশের নিম্নবর্ণিত পৌরসভার মেয়রদের নিজ নিজ পদ হতে অপসারণ করা হয়। গতকাল সরকারের এক পরিপত্রে বলা হয়েছে, অনুপস্থিত ইউপি চেয়ারম্যানদের স্থলে প্যানেল চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করবেন। আর প্যানেল চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে সেখানে ইউএনও/ এসি ল্যান্ড দায়িত্বপালন করবেন। এদিকে, গতকাল বিকালে সচিবালয়ে এ বিষয়ে কথা বলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা- জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে এখন হাত দিচ্ছি না। যাচাইবাছাই করে দেখা যাক সেখানে কার্যক্রম কী রকম আছে, যদি পরবর্তীকালে প্রয়োজন হয় বা প্রয়োজনের তাগিদে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয় সেটি নেওয়া হবে। আর দৈনন্দিন যে কাজগুলো নিয়ে প্রত্যেকের আগ্রহের জায়গা ছিল যেমন- জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনসহ অন্যান্য যে কাজগুলো দৈনন্দিন করতে হয় সেগুলো যাতে চালু থাকে, গ্রামীণ পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম যেন চলমান থাকে সেজন্য প্রথম দিকেই স্থানীয় যারা সরকারি কর্মচারী আছেন তাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
আজ-কালের মধ্যে প্রত্যাহার হচ্ছে সব জেলা প্রশাসক : উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আজ বা কাল বুধবারের মধ্যে তাদের প্রত্যাহার করা হবে। এরপর নতুন করে ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। গতকাল রাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের কক্ষে ডিসিদের ফেরানো নিয়ে এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন, অর্থসচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদারসহ এসএসবির একাধিক সদস্য। জানা গেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনে অনেক ডিসিও অনীহার কথা জানিয়েছেন। তারা মাঠ প্রশাসন থেকে ফেরত নেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। সবমিলিয়ে সব জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া জেলা প্রশাসক পদে বর্তমানে বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিসি ফিট লিস্টের পুরনো তালিকা বাতিল করে নতুন তালিকা করা হচ্ছে। নতুন ডিসি হিসেবে ২৪, ২৫, ২৭ ব্যাচ থেকে বঞ্চিতদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। একাধিক সূত্র জানায়, ডিসি নিয়োগ ইস্যুতে বিগত সরকারের আমলে বঞ্চিত পাঁচজন কর্মকর্তার সহায়তাও নেওয়া হবে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নিয়োগ বাতিল, নতুন নিয়োগ ও বদলি হচ্ছে।