পুলিশের এসআই ও সার্জেন্ট পদে নিয়োগে শত কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে সারদা পুলিশ একাডেমিতে মৌলিক প্রশিক্ষণরত এসব বেশির ভাগ প্রার্থীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছিল ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট সবকিছু সমন্বয় করেছেন। এই চক্রে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই তিন কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের একজন সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিযোগের পর প্রাথমিক তদন্তে এরই মধ্যে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছে একটি সংস্থা। তারা একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় পুলিশে নিয়োগের নামে দুর্নীতি। এক্ষেত্রে তিনি একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তার নির্দেশে চক্রটি এসআই (সাব-ইন্সপেক্টর) ও সার্জেন্ট নিয়োগে মেধাবী ও যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্য ও অদক্ষদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। ২০২৩ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ ব্যাচের নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৮০০ জনের মধ্য হতে ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ৮২০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৪০তম আউট সাইড ক্যাডেট ব্যাচের এই ৮২০ জন বর্তমানে এক বছর মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণে রয়েছেন সারদা পুলিশ একাডেমিতে। গত ২০২৩ সলের ৫ নভেম্বর তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সূত্র বলছে, পুলিশের নিয়োগ বাণিজ্যের অন্তরালে ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি তার প্রভাব বিস্তার করে মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দপ্তরে নিজের পছন্দের কর্মকর্তার সমন্বয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠন করাতেন। নিয়োগ বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন অতিরিক্ত আইজি ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ (সাবেক ডিজি র্যাব ও বর্তমানে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে সংযুক্ত)। এ ছাড়া ওই বোর্ডে তার কথিত ক্যাশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম-সচিব মীর আবুল ফজল, উপ-সচিব মাহবুবর রহমান শেখ, ডিআইজি কাজী জিয়া উদ্দীন এবং এআইজি আমজাদ হোসেন নিয়োগ বাণিজ্যে সহায়তা করতেন। সূত্র আরও বলছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিন্ডিকেটের মধ্যে মীর আবুল ফজল এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর অত্যন্ত আশীর্বাদপুষ্ট যুগ্ম-সচিব ধনঞ্জয় দাস। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পক্ষে এক একজন প্রার্থীর কাছ থেকে ২০ হতে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে পছন্দের তালিকা প্রস্তুত করতেন। ঘুষ না দিলে তাকে ভাইভায় ফেল করিয়ে দেওয়া হয়। তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ প্রদানের ফলাফল প্রস্তুতসহ অন্যান্য কার্যক্রম অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সম্পাদন করতেন এআইজি আমজাদ হোসেন। তিনিও পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করেছেন বলে পুলিশ সদর দপ্তরে গোপন প্রতিবেদন জমা হয়। এর ভিত্তিতে তাকে অন্য শাখায় বদলি করা হয় বলে পুলিশের মধ্যে আলোচনা রয়েছে। রাজধানীর উত্তরায় একটি ফ্ল্যাটে চক্রের সদস্যরা ঘুষের টাকা লেনদেন করতেন।
সূত্র জানায়, এর বাইরে ২০২৪ সালে আউট সাইড ক্যাডেটের নতুন একটি ব্যাচ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। ইতোমধ্যে লিখিত পরীক্ষা পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় ৩ হাজার ২০০ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্য থেকে আগের মতোই একইভাবে ওই চক্র বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে। এই নিয়োগে এআইজি আমজাদ হোসেন এবং যুগ্ম-সচিব মীর আবুল ফজল ব্যাপকভাবে মরিয়া হয়ে ওঠেন। মাঠ পরীক্ষা হতে চূড়ান্ত নিয়োগ পর্যন্ত পার করার উদ্দেশে এক একজন পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩০ হতে ৩৫ লাখ টাকা প্যাকেজ আকারে গ্রহণ করেছেন বলে তথ্য পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা অনিয়ম, দুর্নীতিকে এখনই না বলা উচিত। যারাই দুর্নীতি করবে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। নাহলে সমাজে যোগ্যরা পিছিয়ে পড়বে। এতে বৈষম্য বাড়বে। অপরাধ বিশ্লেষক এবং মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে একটি সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। সত্যতা পাওয়া গেলে যারা ঘুষ নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। আর যারা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গণঅভ্যুত্থান কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বিগত সময় ধরে চলা অন্যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এর ধারাবাহিকতায় আমরা দেখেছি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দীর্ঘ সময় ধরে সরকারের পেটুয়া বাহিনী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। গত ১৫ বছরে সরকার তাদের আজ্ঞাবহ এবং নিজস্ব লোক ঢুকিয়ে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছিল। তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে খবর এসেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কীভাবে দুর্নীতি করেছেন। ওই দুর্নীতির অংশ হিসেবে এখন সারদায় প্রশিক্ষণরত পুলিশের দুটি ব্যাচ ঢুকছে। আমারা চাই এদের পুনরায় পূর্ণাঙ্গ রূপে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে নিয়োগ দেওয়া হোক। নইলে দুর্নীতিতে আগের সিস্টেমই বহাল থাকবে।