অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তাঁর বাসভবন যমুনায় পৃথক বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতসহ কানাডা ও মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার। বৈঠকে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে কানাডাকে বড় বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় দেশটি বাংলাদেশে সার ও নিত্যপণ্য সরবরাহ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সোলার পার্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছে ফ্রান্স। অপরদিকে মালয়েশিয়ার হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে আসিয়ানের সদস্য হতে দেশটির সমর্থন চান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আসিয়ান ও সার্কের মধ্যে সেতু হতে পারে।
গতকাল দুপুরে প্রথমে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারি মাসদুপুই, পরে কানাডার হাইকমিশনার লিলি নিকোলস এবং সবশেষে মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মোহাম্মদ হাশিম প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তারা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।
কানাডা : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে পুনর্গঠনে কানাডাকে বড় বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে অর্থনীতি ঠিক করা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে তাঁর সরকারের জন্য কানাডার সহায়তা প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমাদের বড় বিনিয়োগ দরকার। অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে এমন একটি অর্থনীতি পেয়েছে, যা বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝাসহ সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। প্রফেসর ইউনূস কানাডার শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও উন্নয়ন সংস্থাসহ দেশটির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সম্পর্কের কথা স্মরণ করে বলেন, পূর্ববর্তী সরকারের দ্বারা ভেঙে পড়া গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরুদ্ধার করছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রশাসনে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা আনছে।
এ সময় কানাডার হাইকমিশনার বলেন, তাঁর সরকার প্রধান উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। একই সঙ্গে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা জোরদারে সার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে দেশটির আগ্রহের কথাও জানান তিনি। জিএসপি সুবিধা প্রসঙ্গে হাইকমিশনার বলেন, কানাডা থেকে বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে অবশ্যই কারখানাগুলোতে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, যেসব ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনে তাদের উদ্বেগ নিরসনে তাঁর সরকার আইএলওর মানদন্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখবে। এ সময় বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনকে সমর্থন করতে কানাডার আগ্রহের বিষয়টি তুলে ধরেন লিলি নিকোলস। জবাবে প্রফেসর ইউনূস বলেন, ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন বিপ্লব দেশে নতুন আশার সূচনা করেছে। এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। এই সুযোগ হয়তো আর কখনোই ফিরে আসবে না। তিনি আরও বলেন, দেশে ভোট অনুষ্ঠানের আগে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনি সংস্কার করা হবে। বিগত সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনি কারচুপির কারখানায় পরিণত করা হয়েছিল। কানাডার হাইকমিশনার বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর ক্রমবর্ধমান সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তাঁর দেশ রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অনুদান দিয়েছে। রোহিঙ্গা জনগণের জীবন-জীবিকার সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান জানান তিনি। প্রধান উপদেষ্টা কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে কিছু রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করে রোহিঙ্গা শিবিরে উপচে পড়া ভিড় কমিয়ে আনার কথা বলেন। তিনি বলেন, তার সরকার রোহিঙ্গা তরুণদের মধ্যে আশার আলো দেখাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।
ফ্রান্স : প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপুই বলেন, রাষ্ট্র পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে তাঁর দেশ। তিনি বলেন, ফ্রান্স বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছে। দুর্নীতি, মানব পাচার, সাইবার অপরাধ, স্থলবন্দর ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা এবং আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধে যে কার্যক্রম শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, তার দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করতে চায় ফ্রান্স।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ প্রধান উপদেষ্টাকে সুবিধাজনক সময়ে ফ্রান্স সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলেও অবহিত করেন রাষ্ট্রদূত। তিনি জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে নিহত ছাত্র-জনতার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিপ্লব অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ পুনর্গঠনের সুযোগ দিয়েছে যা আগে কখনো হয়নি। তিনি বলেন, এটি একটি বড় কাজ। তবে আমরা এটিকে একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছি। আমরা যদি সুযোগটি কাজে না লাগাই, তাহলে এটি একটি বড় ব্যর্থতা হবে। তিনি বলেন, ‘জনগণ যতদিন চাইবে ততদিন থাকবে’ অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি দেশের সব শ্রেণির মানুষকে একটি বড় পরিবারের অংশ হিসেবে দেখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, কখনো কখনো আমরা খুব জোড়ালোভাবে একমত নই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা শত্রু। তাঁর সরকার প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
ফরাসি রাষ্ট্রদূত, অলিয়েস ফ্রাসেস ঢাকায় আগামী অক্টোবরে ৬৫তম বার্ষিকী উদযাপনের বিষয়টি উল্লেখ করে ওই অনুষ্ঠানে ড. ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানান। ফ্রান্স ২০২৫ সালের এপ্রিলে প্যারিসে দুই সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মৌসুম আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে শুল্ক ও কর্তৃপক্ষের বাধার অভিযোগ করেন ফরাসি রাষ্ট্রদূত। এ সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডা বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। রাষ্ট্রদূত জানান, ফরাসি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে তিনটি সোলার পার্ক স্থাপন এবং দেশের ১৫টি বজ্রপ্রবণ জেলায় ‘লাইটনিং অ্যারেস্টার’ স্থাপনে আগ্রহী।
মালয়েশিয়া : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতি সংস্থার (আসিয়ান) সদস্য হতে মালয়েশিয়ার সমর্থন চান। জবাবে দেশটির হাইকমিশনার হাজনাহ হাশিম বলেন, কুয়ালালামপুরে আসিয়ানের পরবর্তী চেয়ার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তিনি আসিয়ান সদস্যপদ সংক্রান্ত বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূসের বার্তা মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেবেন বলেও জানান। হাইকমিশনার বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত তাঁর দেশ। তিনি বলেন, আমরা আপনার ওপর বিশ্বাস রাখি।
প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদসহ দেশটির নেতাদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করে বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্ক বাড়াতে আমরা আমাদের সেরাটা দিই। প্রফেসর ইউনূস মালয়েশিয়ার অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইউনূস সেন্টার’-এর কার্যক্রম রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, ওই সেন্টারগুলো সামাজিক ব্যবসার ধারণা প্রচারের মাধ্যমে তিন শূন্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে।
হাইকমিশনার জানান, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানি বাংলাদেশে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। তাঁর দেশ বাংলাদেশের শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে আরও বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক বলেও জানান। এ সময় মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রামভিত্তিক একটি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে গাড়ি বিতরণ ও সংযোজন করার জন্য চুক্তি করেছে বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কুয়ালালামপুর মেডিকেল ট্যুরিজমের জন্য একটি কাক্সিক্ষত গন্তব্য হতে পারে বলেও উল্লেখ করেন হাইকমিশনার। তিনি বলেন, বাংলাদেশিরা সাশ্রয়ী মূল্যে মালয়েশিয়ায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করতে পারেন।
সংস্কারের জন্য ইউএনডিপির সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা
বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন, কর প্রশাসন এবং ভূমি নিবন্ধনের মতো বিস্তৃত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করতে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সমর্থন চেয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলা সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে এ সহায়তা চান তিনি।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ফল জনগণ যাতে উপভোগ করতে পারে, সে লক্ষ্যে তিনি দেশের প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনতে চান। প্রধান উপদেষ্টা ট্যাক্স এবং ভূমি প্রশাসন ডিজিটালাইজেশনের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, একজন নাগরিক যেন কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই কর দিতে এবং তাদের সম্পত্তি বিক্রয় ও নিবন্ধন করতে পারে। তিনি আরও বলেন, তাঁর সরকার বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের জন্য ইউএনডিপির সহায়তা চায়। এ ছাড়া একটি আধুনিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা এবং দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।