বিভিন্ন খাল-নালা দখল-দূষণের কারণে লক্ষ্মীপুরে বন্যার পানি নামছে ধীরগতিতে। ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছে নিম্নাঞ্চলের ৮ লাখ বাসিন্দা। এ ছাড়া থেমে থেমে বৃষ্টি ও নোয়াখালী-ফেনীর পানি ঢুকে এখনো প্লাবিত রয়েছে অনেক এলাকা। ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতির দিকে। তবে প্লাবিত বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নামছে খুবই ধীরগতিতে। বন্যার সময় যারা বাড়ি ছেড়েছেন তারা ফিরতে শুরু করেছেন। কারও বাড়িতেই ফার্নিচার ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী ব্যবহারোপযোগী নেই। বাড়ির কোনো লেপ-তোশকও আর ব্যবহার করা যাবে না। কুমিল্লায় কিছু কিছু এলাকার মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। যে এলাকায় খাল দখল ও ভরাট হয়ে গেছে সেখানে পানি ধীরে নামছে। এতে ঘরে ফিরে যেতে তাদের আরও ছয়-সাত দিন লেগে যেতে পারে।
বন্যার পানি সম্পূর্ণভাবে নামার পর পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। এদিকে গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১১ জেলায় চলমান বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৯-এ দাঁড়িয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ৫৪। এখন পর্যন্ত ফেনীতে মারা গেছেন ২৩ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫৯ মৃতের মধ্যে পুরুষ ৪১, নারী ৬ ও শিশু ১২ জন। এর মধ্যে কুমিল্লায় ১৪, ফেনীতে ২৩, চট্টগ্রামে ৬, খাগড়াছড়িতে ১, নোয়াখালীতে ৯, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১, কক্সবাজারে ৩ ও মৌলভীবাজারে ১ জন। নিখোঁজ লোকসংখ্যা ১ (মৌলভীবাজার)। বন্যা আক্রান্ত ১১ জেলা হলো ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এতে আরও বলা হয়, ৬৮ উপজেলা বন্যা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন/পৌরসভা ৫০৪টি। বর্তমানে মোট ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭০২।
পানিবন্দি/ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মোট ৩ হাজার ৯২৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় মোট ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৫ জন মানুষ এবং ৩৬ হাজার ১৩৯টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য মোট ৫১৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সকল পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সংগ্রহ করা মোট ১ লাখ ৪০ হাজার ৯০০ প্যাকেট শুকনা খাবার, কাপড় ও পানি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বন্যাকবলিত এলাকায় পাঠানো হয়েছে। সার্বিকভাবে দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে লোকজন নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরছে। বন্যাদুর্গত জেলাগুলোয় যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরে ধীরগতিতে পানি নামছে। চলমান বন্যায় জেলার বিভিন্ন খাল-নালা দখল-দূষণে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন নিম্নাঞ্চলের ৮ লাখ বাসিন্দা। মেঘনার পানির উচ্চতা বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হলেও ডাকাতিয়া নদী, রহমতখালি, ওয়াপদা, ভুলুয়া খালসহ অধিকাংশ খালের আশপাশে বসবাসরত বাসিন্দারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। থেমে থেমে বৃষ্টি ও নোয়াখালী-ফেনীর পানি ঢুকে এখনো প্লাবিত রয়েছে অনেক এলাকা।
জানা যায়, বর্তমানে ৪০ হাজার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে। কিছু মানুষ আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঠাঁই নিয়েছে। তবে পানিবন্দি অধিকাংশ মানুষ চুরি-ডাকাতির ভয়ে বাড়িঘর ছাড়েনি। জীবনযুদ্ধে লড়ছে এ উপকূলের বাসিন্দারা। অর্ধাহার-অনাহারে জীবনযাপন করছে তারা।
এখনো পানিবন্দি সদরের ২১ ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চলের ৯টিসহ ১৫ ইউনিয়নের বাসিন্দারা। একই সঙ্গে কমলনগর, রামগতি, রায়পুর ও রামগঞ্জের মানুষ। বাঁচার আকুতি ও ত্রাণের জন্য আর্তনাদ করছে জেলার লাখো বন্যার্ত মানুষ। ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন। চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত ত্রাণ মিলছে না দুর্গম এলাকায়। না-পাওয়ার আক্ষেপ রয়েছে অনেকের। গতকালও ত্রাণ বিতরণ করেছে বহু সংগঠন।
ফেনী : ফেনীর বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতির দিকে। তবে প্লাবিত বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নামছে খুবই ধীরগতিতে। বন্যার সময় যারা বাড়ি ছেড়েছে তারা ফেরা শুরু করেছে। বাড়ি ফেরা মানুষ জানায়, তাদের সাজানো সংসারের সবকিছু বন্যা ধ্বংস করে দিয়েছে। কারও বাড়িতেই বর্তমানে কোনো ফার্নিচার ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী ব্যবহারোপযোগী নেই। বাড়ির কোনো লেপ-তোশকও আর ব্যবহার করা যাবে না। এখনো শহরের পেট্রোবাংলা, মধুপুর, বিরিঞ্চিসহ বিভিন্ন পাড়া পানিতে তলিয়ে আছে। সদর উপজেলার মোটবি, ধলিয়া, পাঁচগাছিয়া, ফাজিলপুর, ধর্মপুর ও ফরহাদনগরের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ এখনো পানিবন্দি। দাগনভূঞার পূর্বচন্দ্রপুরসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি দশা থেকে এখনো মুক্তি পায়নি। অন্যান্য উপজেলার নিম্নাঞ্চল এখনো পানির নিচে। শুক্রবার পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ২৩ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা বন্যা চলাকালে বিভিন্ন সময় মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছে।
কুমিল্লা : কুমিল্লায় কয়েক দিন বন্যার পানি স্থির থাকার পর দু-তিন হলো কমতে শুরু করেছে। বাড়ি ফিরে যাচ্ছে মানুষ। ইতোমধ্যে বেশ কিছু আশ্রয় কেন্দ্রের মানুষ ঘরে ফিরেছে। বিশেষ করে কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে কিছু কিছু এলাকার মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। যে এলাকায় খাল দখল ও ভরাট হয়ে গেছে সেখানে পানি ধীরে নামছে। এতে ঘরে ফিরে যেতে তাদের আরও ছয়-সাত দিন লেগে যেতে পারে।
কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার মনপাল গ্রামের কামাল মিয়া বলেন, ‘মনপাল, তপইয়া ও কৃষ্ণপুরে খাল দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। যে কারণে এ এলাকার পানি ধীরগতিতে নামছে।’
নাঙ্গলকোট উপজেলার জোড্ডা বাজার পাবলিক উচ্চবিদ্যালয় ও আলিম মাদরাসায় গিয়ে দেখা যায়, ওই দুই আশ্রয় কেন্দ্রে ৫০ জনের মতো মানুষ রয়েছে। দুই দিন আগেও সেখানে ৪ শতাধিক মানুষ ছিল। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সাড়ে তিন শ মানুষ ঘরে ফিরেছে। জোড্ডার উত্তরের সব আশ্রয় কেন্দ্র প্রায় খালি হয়ে গেছে। দক্ষিণের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় মানুষ কমতে শুরু করেছে।
জোড্ডা গ্রামের স্বেচ্ছাসেবী আনিসুল হক বলেন, ‘আশ্রয় কেন্দ্রে প্রতিদিন চার শ মানুষের খাবার দিতে হতো। শুক্রবার ৪৮ জনকে খাবার দিয়েছি।’ এদিকে কুমিল্লার লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, চৌদ্দগ্রাম, বরুড়ার উঁচু এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোও ধীরে ধীরে খালি হতে শুরু করেছে। গোমতী তীরবর্তী উপজেলা বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার ও মুরাদনগরেও বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, ‘নিচু এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় মানুষ রয়ে গেছে। অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকার লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। আরও দুই দিন রোদ থাকলে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে।’
চট্টগ্রাম : বন্যায় মিরসরাই, সীতাকু ও ফটিকছড়িতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে খামারিরা। এসব উপজেলায় ঘরবাড়ি-দোকানপাটসহ নানা স্থাপনার পাশাপাশি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে গবাদি পশু-পাখির ৩ শতাধিক খামার। এতে হাজার হাজার গবাদি পশু-পাখির মৃত্যু হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে খামারিদের স্বপ্ন। নষ্ট হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখির খাবারও। জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, জেলার সাত উপজেলায় বন্যায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২০ কোটি ৯৭ লাখ ২৬ হাজার ২০০ টাকার। তার মধ্যে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকার। পশুপাখির মৃত্যু ও দুধ-ডিম বিনষ্টজনিত ক্ষতি হয়েছে ১৬ কোটি ৯ লাখ ৩২ হাজার ৭০০ টাকার।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বন্যায় ডেইরি ও পোলট্রি খাতসহ সব মিলিয়ে ২০ কোটি ৯৭ লাখ ২৬ হাজার টাকার মতো আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের তালিকা করছি, ত্রাণ উপদেষ্টা মহোদয়ও আসছেন। তিনি বলছেন ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি আমরা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মিলে ক্ষতিগ্রস্তদের উপজেলাভিত্তিক তালিকা করছি। অসুস্থ পশুপাখির চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য উপজেলাগুলোয় আমাদের টিম কাজ করছে।’
এদিকে বন্যার পানি সম্পূর্ণভাবে নামার পর পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক। গতকাল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে জেলার সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতিসংক্রান্ত মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
বন্যা ও বন্যাপরবর্তী পরিস্থিতি জানার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে এ সভা আহ্বান করা হয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা স্ব স্ব অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে শেয়ার করেছেন। এর আলোকে যে পুনর্বাসন কর্মসূচি হবে, তার একটা ধারণা পেলাম। যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে। এখনো ত্রাণকার্যক্রম চলমান আছে। বন্যার পানি সম্পূর্ণভাবে নামার পর পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করব।’ এ সময় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল আহমেদ, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাকিব হাসান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহসমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি উপস্থিত ছিলেন।
মৌলভীবাজার : চলতি বন্যায় মৌলভীবাজারে প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি হয়েছে ৮৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকার। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তেও পাড়ে।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসসূত্রে জানা যায়, চলতি বন্যায় এ পর্যন্ত বন্যাকবলিত গবাদি পশুর সংখ্যা ২২ হাজার ৬৯০টি। হাঁস-মুরগির সংখ্যা ৬১ হাজার ১০৯টি। বন্যার কারণে অনেক হাঁস-মুরগি ও একাধিক গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছে। বন্যায় জেলায় মোট ৫৩টি গবাদি পশু ও ৩৫টি হাঁস-মুরগির খামার প্লাবিত হয়েছে। এসব জায়গায় অনেক প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।