নারায়ণগঞ্জ থেকে নিউমোনিয়া আক্রান্ত দুই বছরের ছেলে তানিমকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এসেছিলেন আজমল হোসেন ও জুলেখা বেগম। কিন্তু সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও আসেননি কোনো চিকিৎসক। শ্বাস নিতে না পারায় ছটফট করছে শিশুটি। ছেলের এ অবস্থা দেখে বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকেন জুলেখা আর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নার্স-ওয়ার্ডবয়দের হাতে-পায়ে ধরতে থাকেন আজমল। আজমল বলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে ডাক্তার আমার ছেলের অবস্থা জটিল হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করেছেন। কিন্তু এখানে এসে দেখি চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। আমার বুকের মানিকের প্রাণ যায় যায়। কোথায় গেলে আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারব, কেউ কিছুই বলছে না। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা ‘কমপ্লিট
শাটডাউন’ ঘোষণা করে কর্মবিরতিতে গেলে হাসপাতালজুড়ে তৈরি হয় বিভীষিকার পরিস্থিতি। হঠাৎ এ সিদ্ধান্তে মুমূর্ষু রোগী, দুর্ঘটনায় আহত কিংবা দুরারোগ্য রোগীদের নিয়ে হতবিহ্বল অবস্থায় পড়েন স্বজনরা। জীবন বাঁচাতে অনেক স্বজনকে আহাজারি করতে দেখা যায়। পটুয়াখালী থেকে চিকিৎসা নিতে ঢামেকের জরুরি বিভাগে এসেছিলেন আট মাসের গর্ভবতী আছিয়া খাতুন। আগে থেকেই কিছু জটিলতা থাকায় সম্পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসক। গতকাল হঠাৎ করে তীব্র ব্যথার সঙ্গে রক্তপাত শুরু হয়। আছিয়ার স্বামী হাকিম আকন্দ বলেন, স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক আছিয়াকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু সকাল থেকে এসে হাসপাতালে অপেক্ষা করছি প্রায় ৪ ঘণ্টা হলো, কোনো চিকিৎসক আসেননি রোগী দেখতে। এই মুমূর্ষু রোগী নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। রোগীর অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে, কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মমিনুল ইসলামকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর কোনো চিকিৎসা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেন তার বাবা সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সকালে তেজগাঁও এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ছেলের মাথা ফেটে যায়, শরীরের অন্যান্য জায়গাতেও আঘাত লাগে। বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বসে থেকেও কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। এদিকে ছেলের শরীর থেকে রক্ত ঝড়ছে। গাছ থেকে পড়ে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙেছে মুন্সীগঞ্জের গাজরিয়ার ফিরোজ মিয়ার। ঢাকা মেডিকেলের মূল বিল্ডিংয়ের নিচ তলার ১০০ নম্বর ওয়ার্ডের ২৬ নম্বর বেডে ভর্তি আছেন তিনি। ফিরোজের স্ত্রী বলেন, ‘সকাল থেকে কোনো ডাক্তার আসেননি, কী করব, কিছু বুঝতে পারছি না।’ বিপাকে পড়েছেন হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তির স্বজনরা। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি আছেন সাদেক আলী। তার বাবা সেলিম আলী বলেন, ‘ছেলে তিন দিন ধরে হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। সকালে একজন চিকিৎসক এসেছিলেন। এরপরে আর কোনো চিকিৎসক আসেননি। খোঁজ নিতে গিয়ে শুনলাম চিকিৎসকরা কর্মরিবতি পালন করছেন। একথা শোনার পর থেকে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। আমার ছেলে এখনো বেঁচে আছে চিকিৎসার কারণে। এখন ডাক্তার যদি না আসেন তাহলে আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারব না।’ ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগেও ছিল রোগীর ঢল। সকালে ঘণ্টাখানেক রোগী দেখার পরে কর্মবিরতি শুরু করেন চিকিৎসকরা। কর্মবিরতির ঘোষণায় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগী নিয়ে হাসপাতালে এসে বিপত্তিতে পড়তে হয় স্বজনদের।