ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন বিএনপির হাইকমান্ড। এর পরও থেমে নেই বিএনপির কিছু নেতার নানা অপকর্ম। দলটির দপ্তরসূত্র জানান, গত এক মাসে ৫ শতাধিক নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। জানা গেছে, শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণায়ও টনক নড়েনি অনেক নেতার। তাঁরা বিভিন্ন অপকর্মের পাশাপাশি টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের আশ্রয়প্রশয়দাতা হয়ে উঠছেন। এর মধ্যে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রুহুল আমীন দুলালের বিরুদ্ধে উঠেছে আরও গুরুতর অভিযোগ। দলের নেতা-কর্মীদের আবেগ আর ভরসার স্থল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর হামলাকারী হিসেবে চিহ্নিত নেতাকে তিনি নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছেন বলে তৃণমূলে বিরাজ করছে ক্ষোভ। এরই মধ্যে দলের পক্ষ থেকে তাঁকে শোকজ করলেও থোরাই কেয়ার দুলালকে যেন থামানোর কেউ নেই।
বিএনপি নেতারা জানান, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইতোমধ্যে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পদধারী অনেক নেতার নেতিবাচক কর্মকাে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠলে শাস্তি প্রদানের নীতিতে যেতে বাধ্য হয় দলটি। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ সারা দেশে দলটির ৫ শতাধিক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার, কারণ দর্শানো নোটিস দেওয়ার মতো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। এমনকি এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের হাতে সোপর্দ করারও নির্দেশনা রয়েছে।
সূত্রগুলো বলছেন, এর মধ্যেই সারা দেশে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা-কর্মী অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রুহুল আমীন দুলাল ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কে এম হুমায়ুন কবির এবং তাঁদের অনুসারীরা। উপজেলায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার দখল ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ড্রেজার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা দখল, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ সর্বত্রই তাঁদের দাপট। নেতাদের এসব লুটপাট-দখলের ভিডিওচিত্র দলের কেন্দ্রীয় অনেক নেতার কাছে পাঠিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। শিকদার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং যমুনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৬ আগস্ট রুহুল আমীন দুলালের অনুসারীরা দখলে নেন বলে এর মালিক অধ্যাপক আজিমুল হক অভিযোগ করেন। ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তৎকালীন ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি বায়েজিদ আহমেদ খান রাজধানীর কারওয়ান বাজারে খালেদা জিয়ার ওপর হামলা চালান। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় তারেক রহমানকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপ্রীতিকর ও কটূক্তি করে অনেক পোস্ট করেছেন। ৫ আগস্টের পর রুহুল আমীন দুলাল এ বায়েজিদ আহমেদ খানকে তাঁর মঠবাড়িয়ার বাসায় প্রায় রাতেই আশ্রয় দেন। অভিযোগ রয়েছে, ৫ আগস্টের পর মঠবাড়িয়া থানায় রুহুল আমীন দুলাল ও তাঁর অনুগতদের দিয়ে থানা কবজায় নিয়েছেন। কোনো ভুক্তভোগী থানায় গেলে এ সিন্ডকেটের অনুমতি ছাড়া মামলা বা অভিযোগ নেওয়া হয় না। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার বলেন, ‘এটা দুঃখজনক।’ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হাশিমকে বহিষ্কার করা হয়।
বিএনপিসূত্র জকারণ, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নানা অভিযোগে এখন পর্যন্ত শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার এবং পদ স্থগিত করা হয়েছে। শাস্তি পাওয়া নেতাদের বেশির ভাগই ঢাকা মহানগরী, বগুড়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল, পঞ্চগড়, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, নোয়াখালী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট ও লক্ষ্মীপুর জেলার। গত কয়েক দিনে দলের শৃঙ্খলা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় আরও কঠোর হয়েছে দল। জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই সতর্ক বিএনপি। সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত সহিংস কর্মকা , দখলবাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হুমকিধমকিসহ যে কোনো ধরনের অপকর্ম রোধে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কঠোর বার্তা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘কোনোরকমের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সহিংসতা বরদাশ্ত করা হবে না। বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীর ঠাঁই হবে না। বরং কেউ চাঁদাবাজি করলে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে।’ এদিকে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলো ব্যবস্থা নিচ্ছে। দলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কোনো পর্যায়ের নেতাকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।