দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যবসায়ীদের নামে হয়রানি ও নির্যাতনমূলক হত্যা মামলাকে শিল্প খাত ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন অংশীজনেরা। তাঁরা বলছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প কারখানাগুলোয় অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চক্রান্ত চলছে। বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর নামে হত্যা মামলায় ক্রেতারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ছেন। দেশের অর্থনীতির এ ক্রান্তিকালে শিল্প খাতের সুরক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা এবং নজরদারি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আইনজ্ঞরা বলছেন, বড় বড় ব্যবসায়ীদের নামে মিথ্যা হত্যা মামলা কেবল আইনের ব্যত্যয়ই নয়, দেশের জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের পরিপন্থি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। এর পর থেকে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শাসনকালে ক্ষমতাধরদের নামে সারা দেশে মামলা হয়। এতে এমন ব্যবসায়ীদেরও আসামি করা হচ্ছে, যাঁদের রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতা নেই। সূত্র বলছেন, চাঁদা ও তৈরি পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ না পেয়ে এবং অনৈতিক সুবিধার জন্য অনেক ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন- এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে এখন হত্যা মামলার নামে অরাজকতা চলছে। এ ব্যর্থতার দায় সরকারের। যারা এমন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের শাস্তি দিতে হবে। এসব মামলার বাদীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এফবিসিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, একটি সুকৌশলী কুচক্রী মহল সমাজ ও অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ অশুভ গোষ্ঠীকে প্রতিহত ও পূর্ণশক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন গণ আন্দোলনের ফলস্বরূপ উদ্ভূত নতুন বাংলাদেশ এবং প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর পূর্ণ আস্থা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। আমরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায় সংস্কৃতির সামগ্রিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে দেশের ব্যবসায়ীসমাজের মধ্যে দায়িত্বশীল ব্যবসা পরিচালনার নতুন অধ্যায় সূচনা করতে আগ্রহী।
ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপির তথ্যমতে, ৫ আগস্ট থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর থানাগুলোয় হত্যা মামলা হয়েছে ২৪৮টি। অনুসন্ধান বলছে, মামলার বেশির ভাগ এজাহার একই ধরনের। প্রথম ১০ থেকে ২০ জন আসামি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ প্রভাবশালী কিছু পুলিশ কর্মকর্তা। এসব মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাদী চেনেন না আসামিকে। আসামিও বাদীর নাম শোনেননি কখনো। ২৫ আগস্ট ঢাকার দোহার থানায় হয় তেমনই একটি মামলা। এজাহারে থাকা ঠিকানার সূত্র ধরে আসামির খোঁজ করে জানা যায়, রাজনৈতিক পরিচয় না থাকা অভিযুক্ত ষাটোর্ধ্ব এ ব্যক্তি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একজন। গণমাধ্যমে তিনি দাবি করেন, ‘গত ১০ বছরেও দোহার যাইনি। ব্যবসা করি জীবনভর, সে হিসেবেই সরকারে যে-ই থাকে তাদের সঙ্গেই আমাদের সখ্য থাকে। কিন্তু আমরা কোনো রাজনীতি করি না, কখনো করিও নাই। আমার নামে হত্যা মামলা হয়েছে, অথচ গত ১০ বছরে আমি দোহার যাইনি। কেন কীভাবে কিছুই বুঝতে পারছি না। সরকারের কাছে আবেদন করব-আমাদের যেন এভাবে অপদস্থ না করা হয়।’ এ শিল্পপতিসহ ১৭৪ জনের নামে মামলার বাদী শাজাহান মাঝি অধিকাংশকেই চেনেন না। তাহলে কেন করলেন মামলা? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, রাজনৈতিক মামলা তাই সবাইকে চেনেন না, নেতারা যাদের নাম দিয়েছে তাদের নামই মামলায় উল্লেখ করেছেন।
এদিকে ২ সেপ্টেম্বর একই ধরনের একটি মামলা হয় রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায়। আসামি বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী; যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি অভিযুক্তদের। তবে পুলিশ বলছে, বিনা অপরাধে কেউ শাস্তি পাবে না। কে দোষী এবং কে নির্দোষ তা খুঁজে বের করার জন্যই প্রাথমিকভাবে তদন্ত করতে হবে। তদন্তের ফলেই যে দোষী থাকবে আর যে নির্দোষ সে মামলা থেকে বাদ যাবে। অযথা কাউকে হয়রানি করা হবে না বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে গণহারে এমন মামলায় প্রকৃত দোষীরা পার পেয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সুহান খান বলেন, ‘ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অভিযোগের প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কাউকে আসামি হিসেবে শনাক্ত করলে বা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে হলে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অভিযোগের প্রয়োজন। তবে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি-৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও তাদের ঢালাওভাবে মামলায় পক্ষভুক্ত করা হচ্ছে; যা কেবল আইনের ব্যত্যয়ই নয়, দেশের জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের পরিপন্থি।’
পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, ‘একটি গোষ্ঠী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়। তারা বিভিন্নভাবে শিল্পকারখানায় হামলা-ভাঙচুর করছে। যারা হামলায় অংশ নিচ্ছে রাজনৈতিকভাবে মোটিভেটেড। পুলিশ না থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। আর সেই সুযোগে দুষ্কৃতকারীরা এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটাচ্ছে। কোনো পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দুই বছর আগের পুরনো ক্ষোভের জেরে এখন হামলা করা হচ্ছে। মোট কথা হামলাকারীরা দেখছে পুলিশ আছে নাকি নাই। যখনই দেখছে পুলিশ নাই, তখনই হামলা করছে। তারা জানে পুলিশ না থাকলে তাদের কেউ গ্রেপ্তার করবে না।’
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রবিরোধী একটি চক্র অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে ক্ষমতায় আসতে চায়। তারাই দেশের শিল্পকারখানায় আক্রমণ করছে। তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে কারখানা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়, সে কারখানায় শ্রমিকরা হামলা-ভাঙচুর করতে পারে না। শিল্পকারখানায় হামলা-ভাঙচুরের সঙ্গে শ্রমিকরা জড়িত না।’
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, ‘জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর করে কারখানা বন্ধকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিচারের ব্যবস্থা না করলে উৎপাদন স্বাভাবিক হবে না। কলকারখানা ঠিকমতো না চললে লাখ লাখ মানুষ বেকার হবে। কলকারখানা সুষ্ঠুভাবে চালানোর পরিবেশ নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।’
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে মামলায় কারা আসামি হবেন-না হবেন তা অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ করছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার ক্ষমতার পালাবদলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা নেতারা। আবার কোনো কোনো নেতাকে ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরাও তাদের প্রতিপক্ষকে মামলায় ফাঁসাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। ঢাকার পাশের শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জেই এমন পাঁচটি মামলা পাওয়া গেছে, যাতে অন্তত সাতজন ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়। তাঁদের বিষয়ে অনুসন্ধান করে উপরোক্ত তথ্য ও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুটি হত্যা মামলা আড়াইহাজার থানার। মামলা দুটিতে আসামি করা হয়েছে বৃহৎ রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফকির গ্রুপের তিনজনকে। তাঁরা হলেন ফকির নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামান ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মাশরিকুজ্জামান নিয়াজ এবং ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ। উভয় মামলায় ঢাকার বাইরের একজন পরিবহন ব্যবসায়ীকেও আসামি করা হয়। মামলা দুটির এজাহারের বর্ণনা প্রায় একই। দুই এজাহারেই এসব ব্যবসায়ীর নামের ক্রমিকও একই।
সূত্র বলছেন, ফকির গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজারের মতো কর্মী রয়েছেন। তাঁদের তৈরি পোশাক কারখানার ঝুটসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত মালামালের ব্যবসা করেও অনেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এটি আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একাধিক পক্ষ এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্রিয় হয়। এর জেরে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ব্যক্তিদের নাম আড়াইহাজার থানার দুটি হত্যা মামলায় জড়ানো হয়। ৫ আগস্ট হাফেজ সোলাইমান নিহত হওয়ার ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় করা মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আরএস নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিকেএমইএর সহসভাপতি মোরর্শেদ সারোয়ারকেও আসামি করা হয়। তিনি কখনো রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। একইভাবে ফতুল্লা থানার একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে ভুঁইগড়ের এসবি স্টাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানকে। তিনিও রাজনীতি করেন না।