নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারের রূপরেখা গ্রহণ করতে যাচ্ছে, তা চার ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে কিছু সংস্কার তাৎক্ষণিকভাবে, কিছু সংস্কার স্বল্প মেয়াদে, কিছু মধ্যমেয়াদে এবং কিছু সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন হবে দীর্ঘমেয়াদে। যেসব সংস্কার কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করবে না। রেখে দেওয়া হবে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী সরকারের জন্য। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়ে দিয়েছে, সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত ছয় কমিশন কাজ করবে তিন মাস মেয়াদে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কমিশনগুলোর মেয়াদ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আলোচ্য সময়ের পর তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রস্তাবিত সংস্কার কার্যক্রমের সুপারিশ সংবলিত রিপোর্ট জমা দেবে। এর পর এসব সুপারিশ যাচাইবাছাইয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। জানা গেছে, সংস্কার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ অনুষ্ঠানের বিষয়গুলো সমন্বয় করবেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। সূত্র জানায়, রাজনৈতিক সংলাপের পর প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত সংস্কার উদ্যোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তথা ছাত্র-জনতার ‘মতামত’ নিতে তা অনলাইনে তুলে ধরা হবে। পরবর্তীতে সংস্কার কার্যক্রমগুলো গুরুত্ব অনুসারে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর মধ্যে কোন সংস্কারগুলো গুরুত্ব অনুসারে অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার মতামত নেওয়া হতে পারে। মূলত, অন্তর্বর্তী সরকার স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পাশাপাশি একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ধারাবাহিক কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সূত্রগুলো জানাচ্ছে, কিছু সংস্কার উদ্যোগ রয়েছে যা অগ্রাধিকারভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য। এ ধরনের সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে প্রস্তাবিত ছয় কমিশন যুক্ত হবে না। উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পর পরই এসব সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। বিগত ফ্যাসিবাদ সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে অব্যাহতি দেওয়া, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, পুলিশ বাহিনীকে সক্রিয় করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং জুলাই বিপ্লবে সংগঠিত গণহত্যার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তাৎক্ষণিক এসব উদ্যোগের বাইরে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে রিপোর্ট দেবে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশন। সংস্কার কমিশন যেসব সংস্কার সুপারিশ রিপোর্টে তুলে ধরবেন, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন না। বরং গঠিত কমিশনের সংস্কার বিষয়ক সুপারিশ পাওয়ার পর সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানান, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচনব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার অপরিহার্য বলে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পর, পরবর্তীতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে যাতে কোনো রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে না পারে; এক ব্যক্তি বা পরিবার বা কোনো গোষ্ঠীর কাছে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত না থাকে, সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধান এবং নির্বাচন কমিশনেও সংস্কার আনার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। এই বক্তব্যের মধ্যে প্রস্তাবিত ছয় কমিশনের সংস্কার কার্যক্রমের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে।
ভোটের আগে ভোটার তালিকা : সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি সরকার ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। তবে এটি যেহেতু নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে, সে লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে প্রাপ্ত সুপারিশ অনুসারে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের পর পরই ভোটার তালিকা হালনাগাদের কার্যক্রম শুরু করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নির্ভুল ভোটার তালিকা। বিগত স্বৈরাচার সরকারের আমলে করা ভোটার তালিকা নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এমন অনেকে রয়েছে যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য হলেও ভোটার তালিকায় নাম ওঠেনি। করোনা মহামারির কারণে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার করার কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। ফলে আগামী ভোটের আগে একটি নতুন ভোটার তালিকা করার দিকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল জানান, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করব, তার পর আমরা ভোটার তালিকার কাজ চূড়ান্ত করব। আমরা শুধু সংস্কারের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখব না। তার সঙ্গে সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের জন্য, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য, ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা বিলোপ করার জন্য যেসব বাস্তবসম্মত কাজ আছে, তার সবই করব।